Wednesday, April 24, 2013

বন্দিশালা, আউৎসভিজ অথবা বস্ত্রকারখানা



ভবনের নীচে চাপা পড়া অথবা পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া দেহগুলা মানুষ ছিল না কখনো, তারা ছিল শ্রমিক। তাদের শ্রম অতি সস্তা, তাদের রক্ত অতি সস্তা, অতি সস্তা তাদের ঘাম। সব মিলিয়ে তারা আসলে যন্ত্র। তারা বেঁচে থাকে পরের দিন বস্ত্রকারখানা মালিকদের হাতে যান্ত্রিক শ্রম তুলে দেয়ার জন্য। যার পারিশ্রমিক তারা কখনো পায় নাই, পাবেও না। সামান্য বেঁচে থাকার শর্তে  মালিকদের জন্য অনন্তকাল ধরে উদ্বৃত্ত পুঁজি তৈরি করার জন্যই তাদের জন্ম। তারা যে বস্ত্রকারখানা মালিকদের জন্য প্রত্যহ উদ্বৃত্ত পুঁজি তৈরি করছে তাও হয়তো তাদের অজ্ঞাত। তারা বিশ্বাস করে ইশ্বর নয় গার্মেন্ট মালিকরাই সামান্য কটা টাকা দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখে।

ফলে নিজেকে অনন্তশ্রমে রিক্ত করে কলের ভেতর নিজের জীবন সপে দেয়াই তাদের ইশ্বরের জন্য ইবাদত। শুধু নিজের শ্রম নয় তারা উৎপাদন করছে নিজেদের ঔরসে আরো আরো অনন্ত দাসের। জন্মের কিছুদিন পরই তারাও আবার শ্রমিক পিতামাতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে যাত্রা করবে শ্রমের গুহায়। এরা অশিক্ষিত। স্কুলে পড়ার সময় তাদের টান পড়ে ভাত-কাপড়ের। ফলে স্কুলের চেয়ে গুরুতর হয়ে দেখা দেয় তাদের কারখানার কাজ। কারণ কাজ না করলে ভাত বন্ধ। বেঁচে থাকা বন্ধ।

সকালে আর রাতে নগরীর কারখানা এলাকায় কেউ দাঁড়ালে দেখতে পাবে বন্দীশালার বন্দীদের মত কাতারে কাতারে তাদের যাওয়া আসা।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে আউৎসভিজ বলে একটা বন্দিশালা ছিল। যাকে বলা হতো নরক। সেখানে ছিল দানবীয় আকারের গ্যাস চুল্লি। হাজার হাজার মানুষকে যেখানে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তাদের সেখানে গোসল করানোর নাম করে, কাপড় বদলানোর নাম করে ঢোকানো হতো। বন্দিদের পুড়িয়ে মারা হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বন্দীদের ভেতর বাঁচার আকুলতা বয়ে গেলেও গেস্টাপোদের তাতে কিছুই আসতো যেতো না।

অনুরূপভাবে বাংলাদেশের বস্ত্রকারখানাগুলা বিশেষ করে শ্রমিকরা যেখানে কাজ করে। সেসব অনেক আগেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আউৎসভিজে পরিণত হয়েছে তা আমরা বছরের পর বছর ধরে দেখছি। প্রায়শই শ্রমিকরা পুড়ে মরছে। আগুনে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। যে সরকার ক্ষমতায় থাকছে। তারা সেইদিন খুব শোকের ভান করছে। আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে শোকের আর্তনাদ। আমরা প্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি এই নিয়মে। এখন হত্যা আমাদের কাছে তেমন গুরুতর সংবাদ না।সাভারের আউৎসভিজ এই বস্ত্রকারখানায় ১৪০জন শ্রমিককে পুড়িয়ে মারার সংবাদও কিছুদিন পর আরো ফলোআপ পাবে না। আমরা আবার বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বো।

আমাদের আর মনে থাকবে না এই শ্রমিকেরা আগুন লাগার সংকেত পেয়ে নামতে চেয়েছিল। বাধা পেয়েছিলো কারখানা মালিকদের। কারখানা মালিকেরা তাদের সাথে প্রতারণা করেছিল। মিথ্যা বলে ঠেলে দিয়েছিল সোজা মৃত্যুকুপে। তারা বলেছিল আগুন লাগে নাই। ফের তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। এরও আগে উপরের দিকে যেন তারা উঠতে না পারে যেখানে আগুন পৌছে নাই সেখানে তালা লাগিয়েছিল। কারখানা মালিকরূপী জল্লাদ তথা গেস্টাপোদের এরপরও কিছু হবে না। কারণ তারাই রাষ্ট্র টিকিয়ে রেখেছে। রাষ্ট্র নির্মাণ করেছে। তাদেরই অনুগ্রহ পেয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ বসে আছেন তাদেরকে সহযোগিতা দেয়ার জন্য।

গণমানুষতো বানের পানির মতো ইচ্ছা মতো খরচ করা যায়।প্রথাগত কারখানা মালিকদের পত্রিকার কলাম লেখকরা এরপর খুব ব্যস্ত হয়ে কারখানায় কয়টা জানলা করলে শ্রমিকরা আগুন লাগলেও নিচে লাফ দিয়ে মরতে পারবে ইত্যাদি লিখতে থাকবে। কিন্তু ষ্পষ্টতই বলা যায় এইটা হত্যাকাণ্ড। আর এই যুদ্ধের নাম শ্রেণিযুদ্ধ। এইভাবে গণহারে শ্রমিকদের মৃত্যু নাজিদের উল্লাস হয়ে আসে কারখানা মালিকদের। কারণ মানুষগুলো তাদের কাছে শোষণের যন্ত্রমাত্র।

1 comment:

  1. মিডিয়ার লাভ হয়, রাজনীতির লাভ হয়...মানুষরূপী যন্ত্র মরলে নতুন মানুষ যন্ত্র আসে কাজে....পুঁজি কেবল থামে না.....তবেদেশটা কবে যে থেমে যায়!

    ReplyDelete