Wednesday, December 16, 2009

ফ্রাঁসোয়া মোরিয়াকের পাপ বিশ্ব

আমি একজন মেটাফিজিশিয়ান। মূর্তের ওপর কাজ করি। পাপময় ক্যাথলিক বিশ্বকে দৃশ্যগোচর, স্পর্শগ্রাহ্য আর গন্ধবহ রূপ দিতে চাই। ধর্মশাস্ত্রবেত্তারা পাপী সম্বন্ধে আমাদের বিমূর্ত ধারণা দেন মাত্র। আমার কাজ তার সঙ্গে রক্তমাংস লাগানো।
উপরোক্ত কথাগুলো পারী রিভিউ পত্রিকার সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বয়ান করেন। এই হচ্ছেন মোরিয়াক। গড়পড়তা ফরাসি ঔপন্যাসিকদের থেকে একেবারেই আলাদা। নিজেকে একজন ক্যাথলিক হিসাবে সবসময় দাবি করেন। সবাই তা জানে। কিন্তু তাঁর উপন্যাস যে-কোনো আধুনিকের চাইতেও আধুনিক। একটা সময় তিনি লেখা শুরু করবার আগে নাকি ঘণ্টাখানেক বাইবেল পড়তেন, তিনি ভাবতেন এতে গদ্য ভাল হবে। কিন্তু পরে তিনি মত বদলান যে বাইবেলের গদ্য সবধরনের লেখার জন্য উপযুক্ত নয়। তাঁর যে বইটি নিয়ে আলোচনা করতে চাই সেটার নাম “ডেজার্ট অব লাভ” (Le Désert de l’amour)। ফরাসি থেকে এটি ইংরেজী অনুবাদ করেন জন মরিস । প্রকাশক ম্যাকমিলান।
পিতাপুত্র একই নারীর প্রেমে পড়েছে। এরকম সফল উপন্যাস খুব বেশি নাই বিশ্ব সাহিত্যে। ফরাসি উপন্যাসিক ফ্রাঁসোয়া মোরিয়াকের এই উপন্যাসটি এই ধরনের একটি সফল উপন্যাস বলা যায়। এ উপন্যাসে নায়িকা মারিয়া ক্রস মসিয়ে ভিক্তর লারুসেলের রক্ষিতা। তার ছেলের অসুখ হলে ডাক পড়ে শহরের জাদরেল ডাক্তার মঁসিয়ে কোরেজের। ছেলেটাকে অবশ্য শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারেনা ডাক্তার। ফলে মাঝে মাঝে মারিয়াকে দেখতে আসতেন ডাক্তার। মারিয়া ছিল অদ্ভুত রূপসী আর সাক্ষাত প্রেম দেবী যেন। ধীরে ধীরে কোরেজ প্রেমে পড়ে মারিয়ার। মারিয়ার দিক দিয়ে অবশ্য ব্যাপারটা অন্য রকম। ডাক্তার আসলে সমাজে তার সম্মান বাড়ে এই তার পাওয়া। এমনিতে সে মনে মনে বিরক্ত হয়। কেননা ততদিনে স্পস্ট হয়ে যায় কেন ডাক্তার ঘনঘন তার কাছে আসে। ইতিমধ্যে মারিয়ার সাথে পরিচয় হয় ডাক্তারের ছেলে রেমন্ডের ঘটনা মোড় নেয় অন্য দিকে। রেমন্ড স্কুলের ছাত্র। টগবগে রক্ত। একদিন মারিয়াকে বিছানায় টানলে তাকে বাড়ী থেকে বের করে দেয় মারিয়া। রেমন্ডের জীবনে এটা ছিল প্রথম ব্যর্থতা কোনো নারীর কাছে। রেমন্ড বুঝতে পারে তার পিতা কেন এত অসুখি। রেমন্ড বোর্দো ছেড়ে পাড়ি জমায় পারিতে। এদিকে লারুসেল মারিয়া ক্রসকে বিয়ে করে পারিতে নিয়ে যায়। লারুসেল অসুস্থ হয়ে পড়লে মারিয়া চিঠি লিখে ডাক্তারকে নিয়ে যায় পারিতে। এক অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি আছে এ উপন্যাসে। শেষে ডাক্তার এবং রেমন্ড দুজনই বুঝতে পারে না পাওয়াটাই প্রেম। মোটামুটি এই হচ্ছে বইটার কাহিনী।
মহান উপন্যাসিক নিজে ছাড়া অন্য কারো ওপর নির্ভর করেন না। প্রুস্তের সংগে তার কোনো পূবর্সুরীর মিল নাই হয়তো উত্তরাধিকারীরও নাই। মহান উপন্যাসিক নিজস্ব ছাঁচ ভেংগে নেন, তিনিই তার একক ব্যবহারকারী। বালজাক বালজাকীয় উপন্যাসের স্রষ্টা, তার রচনাশৈলী কেবল বালজাকেরই উপযুক্ত। ধার করা রচনা শৈলী বাজে। নিজেদের বক্তব্য পেশ করার জন্য ফকনার থেকে হেমিংওয়ে পযর্ন্ত সব মার্কিন লেখক নিজস্ব শৈলীর ওপর নির্ভর করেছেন।
উপরোক্ত কথাগুলো তিনি বলেন এক সাক্ষাতকারে। কথাগুলো মোরিয়াকের নিজের সম্পর্কেও সত্য। মোরিয়াক ১৮৮৫ সালে বর্দোর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মান। ১৯৫২ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়।

বিষয়: আনাতোল ফ্রাঁস ও সিলভেস্তা বোনার্ডের অপরাধ

আনাতোল ফ্রাঁসের মৃত্যুর কিছুদিন আগে শিকাগো টাইমস পাঠকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ লেখকদের সম্পর্কে তাঁদের মতামত দিতে। ফলাফলে দেখা যায় ১. শেক্সপীয়র ২. গ্যোতে ৩. আনাতোল ফ্রাঁস। আনাতোল ফ্রাঁস অসাধারন হিউমার সমৃদ্ধ ফরাসী লেখক। আমাদের দেশে তিনি কামু অথবা সাত্রের মত পরিচিত নন। ১৮৪৪ সালের ১৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সাহিত্যে বিশেষ করে উপন্যাসে দুই ধরনের স্কুল দেখা যায়। লিটারারি জারনালিজম আর লিটারারি মনাস্টিসিজম। তিনি এই শেষোক্ত স্কুলের লেখক। তিনি নিজেও বলতেন তিনি সমকালীনদের লেখা পড়তেন না সবসময় ক্লাসিকের দিকেই ছিল তার ঝোক। তাঁর লেখা সব বই প্রকাশের সাথে সাথেই ক্লাসিকের স্বীকৃতি পেয়েছে। আনাতোল ফ্রাঁসের আসল নাম Jacques Anatole Thibault. তিনি ঠাট্টার ছলে বলতেন আহা মূল নামটার উচ্চারণই ভুলে গেছি। ফ্রাঁস জন্মেছিলেন এক বইয়ের দোকানদারের ঘরে। সেকেন্ডারী স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকেই তিনি বইয়ের পোকা। পিতামাতা চেয়েছিলেন পাদ্রী হবেন কিন্তু ফ্রাঁস তার বিরুদ্ধে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে ঈনিড পড়তে গিয়ে সামান্যর জন্য বেঁচে যান বোমার আঘাত থেকে। অন্য কোনো কাজেই মন ছিলনা তার। ১৮৭৬ সালে সেনেট লাইব্রেরীতে একটা চাকরি পান। কাজ না করে বই পড়ার অপরাধে সেটাও হারালেন। পরের বছর বিয়ে করেন তার চাইতে বড়লোকের মেয়ে ভালেরি গুয়েরিনকে। বছর দেড়েক সংসার করলেন। মাদাম বুঝলেন স্বামী বস্তুটির মূলত কোনদিকে মনটন নাই কেবল ঐ বই পড়া ছাড়া। তিনি আবার খুব ব্যবসা বুদ্ধি রাখেন। ফলে গন্ডগোল আর বিচ্ছেদ। ফ্রাঁসের জীবনে মাদাম অরমানি দি কেলাভেত ছিলেন সৌভাগ্যের প্রতীক স্বরূপ। ফ্রাঁসের লেখক হয়ে উঠার পেছনে এই ভদ্রমহিলার অবদান স্বীকৃত। ফ্রাঁস আলসেমি করে লেখাটেকা শিকেয় তুলে রাখলে মহিলা বুঝিয়ে তাকে লেখার টেবিলে বসাতেন। মতবাদের দিক থেকে ফ্রাঁস সমাজতন্ত্রী থাকলেও রাজনীতি বিষয়ে চুপচাপ ছিলেন। ব্যঙ্গ, রসবোধ, গভীর বেদনা আর প্রজ্ঞা এই ছিল তার লেখার চরিত্র। আনাতোল ফ্রাঁসের আত্মজীবনী অন লাইফ এন্ড লিটারেচারে তিনি লেখেন বিশ্বাস করুন, আমি মনে করি লেখার চাইতে বাধাকপির চাষ করা ভাল। আর সত্যি যদি লিখতে চান তবে সমসাময়ীকদের লেখা পড়া ঠিক হবেনা। বলা ভাল এই মন্তব্যটি মারাত্মক কিন্তু সত্য। সমসাময়ীকদের লেখা বেশী পড়লে নিজের লেখার মান নেমে যেতে পারে। আজেবাজে লেখাও প্রচারগুণে মহান সাহিত্য হয়ে যায় আজকাল।
আরেক জায়গায় তিনি লেখেন সৌন্দয্যই শক্তি। তাকে ছেড়ে কোথায় যাবে? নারী ফুল নদী জ্যোৎস্না ছেড়ে। যদি আমাকে সুন্দর আর সত্যের মধ্যে একটাকে বেছে নিতে বলা হয় তাহলে আমি সুন্দরকেই বেছে নেব কারণ সুন্দরই একমাত্র সত্য। আরেক জায়গায় লেখেন ইন্দ্রিয় চেতনা শিল্প চেতনার ভিত্তি। মহত শিল্পীদের প্রতিভার চার ভাগের তিন ভাগই ইন্দ্রিয় চেতনা। অনেকে বলে ইন্দ্রিয় চেতনা পাপ-কেন? ভার্জিন মেরী যিনি পাপ ছাড়াই জননী হয়েছিলেন। তবে দয়া করে আমাকে পিতৃত্ব ছাড়াই পাপ করতে দিন। এই রকম অনেক রসময় বাক্যে ভরপুর তার বইটি। তাঁর এ উপন্যাসটি আত্মজীবনীমুলক। মঁসিয়ে বোনার্ড অদ্ভুত রকমের একজন মানুষ। যিনি বইপত্র আর পুরানো পান্ডুলিপি সংগ্রহ করে জীবন কাটান। তাঁর সংসার বলতে ঝি তেরেজা আর প্রিয় বিড়াল হামিলকার। একদিন মঁসিয়ে কোকোজ নামের একজন পান্ডুলিপি বিক্রেতা আসেন। তিনি কিছু আজেবাজে পান্ডুলিপি গছাতে চান বোনার্ডকে। বোনার্ড নেন না তবে লোকটার জন্য দু:খ পান। তেরেজাকে জিজ্ঞেস করেন কোথায় থাকে এই লোক জান? তেরেজা বলে এই দালানের চিলেকোঠায়। বৌটার বাচ্চা হবে। আরও একটা শিশুকে এই পৃথিবীতে আনার জন্য লোকটাকে গালিগালাজ করতে করতে বোনার্ড উপরে কিছু খাবার দাবার পাঠিয়ে দেন। বোনার্ড তাঁর পুরনো পান্ডুলিপির তালিকা খুঁজতে খুঁজতে চর্তুদশ শতকের জ্যাক দ্য ভোরাজিনার-সন্ন্যাসীদের কাহিনীর সন্ধান পান। বইটির নাম গোল্ডেন লেজেন্ড। পান্ডুলিপিটা পাওয়ার জন্য তিনি পাগল হয়ে উঠলেন প্রায়। আট ন মাস পরে বোনার্ড যখন একটা পুরানো ভাস্কর্য ও বইয়ের দোকানে গেলেন তখন মাদাম কোকোজের সাথে তাঁর দেখা হয়। ততদিনে মঁসিয়ে কোকোজ মারা গেছেন। সেই গোল্ডেন লেজেন্ডের জন্য চিঠি লিখতে লিখতে একসময় বোনার্ড একটা চিঠি পান। নেপলস থেকে পান্ডুলিপির মালিক জানাচ্ছেন। ওটা আছে, তবে তিনি হাতছাড়া করবেন না। দেখতে অথবা কাজ করতে হলে ওখানে গিয়েই করতে হবে। ইতি এম এ পলিজি। মদ্য ব্যবসায়ী । সিসিলি। অতএব সিসিলি যেতেই হয়। কিন্তু তেরেজা রাজী না হলে? তেরেজা রাজি তবে সন্ধ্যা ছটার মধ্যে ফেরা চাই। কারণ আজ একটা বিশেষ খাবার সে বানাচ্ছে মঁসিয়ের জন্য। বেচারি জানে না সিসিলি কোথায়! কী করে যে জিনিসপত্র নিয়ে বোনার্ড সিসিলি গিয়ে পৌছান ভগবান মালুম। রেস্তেরাঁয় খেতে গিয়ে এক দম্পতির সাথে তাঁর পরিচয়। দিমিত্রি এবং মাদাম ত্রেপফ। রুশ দম্পতি, তাঁদের শখ জগতের তাবত দেশলাই বাক্স সংগ্রহ করা। কথায় কথায় মঁসিয়ে বোনার্ডের পারির ঠিকানা শুনে মাদাম ত্রেপফ স্তব্ধ হয়ে যান। কারন ইনিই হচ্ছেন সাবেক মাদাম কোকোজ। মাদাম কোকোজ বোনার্ডের বদান্যতার কথা ভুলেননি। এরপর পান্ডুলিপির মালিকের কাছে গিয়ে বোনার্ডের মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়, তিনি জানলেন পান্ডুলিপি ইতোমধ্যে পারিতে চলে গেছে। তিনি আবার পারি ফিরে আসেন। বোনার্ড নিলামখানায় এসে তাঁর সর্বস্ব বাজি রেখে নিলাম ডাকেন। কিন্তু পান্ডুলিপির মালিক নিজেই কার জন্য যেন সর্বোচ্চ নিলামে ডেকে নিলেন। বোনার্ড জানতে চান কে এই লোক। মালিক জানালেন নাম বলা বারণ। কিছুদিন পর বোনার্ডের জন্মদিনে তেরেজাকে একটা বাক্স নিয়ে ঢুকতে দেখে বোনার্ড জিজ্ঞেস করেন কি আছে ওখানে। বোনার্ড খুলে অবাক। একগাদা ফুলের মধ্যে সেই পান্ডুলিপিটা। এইভাবে কাহিনীটা এগোতে থাকে। ফ্রাঁস জীবিত থাকাকালীনই এই বইটা ক্লাসিক হিসাবে সম্মান লাভ করে। পরের ঘটনা আরো মর্মস্পর্শী। বোনার্ড এক বাড়ীতে বইয়ের ক্যাটালগ তৈরী করতে এসে একটি ভারী সুন্দর খুকীকে দেখে তাঁর ভেতর পিতৃস্নেহের হাহাকার টের পান। আহা ক্লেমেনতীন এতদিন তাঁর জীবনে থাকলে তাঁরও এতসুন্দর একটা মেয়ে থাকতে পারতো। পরে তিনি জানতে পান এ আসলে ক্লেমেনতীনেরই মেয়ে, দেখতে অবিকল তার মত। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন মেয়েটার এখন কেউ নেই। তিনি স্কুলে আইনগত ভাবে মেয়েটার ভার নেন। বোর্ডিং স্কুলের এক শিক্ষিকা বোনার্ডের প্রেমে পড়েন। কিন্তু বোনার্ড তাঁকে প্রত্যাখান করলেন। শিক্ষিকা ছোট্ট মেয়েটির উপর নির্যাতন বাড়িয়ে দেন। একদিন বোনার্ড স্কুল থেকে জেনকে নিয়ে আসেন। জেন বড় হয়। বোনার্ডের এক ছাত্রকে ভালবাসে জেন। ছাত্রটি আবার যৌতুক নেবেনা। বিয়ের দিন শোকে উদ্বেলিত বোনার্ড। কি দেবেন নিজের মেয়েকে। কি আছে তাঁর এই বিশাল বই আর পান্ডুলিপির ভুবন ছাড়া। সমগ্র জীবনের সঞ্চয়ের বিনিময়ে যা গড়ে তুলেছেন। বোনার্ড সিদ্ধান্ত নিলেন এই লাইব্রেরীটাই পুরো বিক্রি করে যা পাবেন তা তুলে দেবেন জেন আর তার বরের হাতে। কারণ ততদিনে অকৃতদার বোনার্ড বুঝে গেছেন পিতৃস্নেহের কাছে তাঁর সমগ্র জীবনের অর্জন অতি তুচ্ছ। অসাধারণ এই বইটি আপনাদেরও ভাল লাগবে আশা করি।

নুট হামসুন ও ‘গ্রোথ অব দি সয়েল’ প্রসঙ্গে

পৃথিবীতে যে-ক’জন লেখক একেবারে মাটির কাছাকাছি, তাঁদের মধ্যে নুট হামসুন অন্যতম। নুট হামসুনের এই উপন্যাসটি মহাকাব্যের লক্ষণাক্রান্ত। পড়তে পড়তে অবশ হয়ে যেতে হয়। নরওয়ের বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের বর্ণনা পড়তে পড়তে প্রকৃতির ভেতর ডুবে যেতে হয়। এ-উপন্যাসের নায়ক আইজাক যেন আদম। এই বনাঞ্চলে সে-ই যেন প্রথম মানবসন্তান। এই অবারিত প্রকৃতির ভেতর সে গড়ে তুলতে চায় তার বাসস্থান। এই অনাবাদী জমিতে সত্যি সত্যি সে একটা ঘর বানায়। বাস করতে থাকে। ফসল হতে থাকে তার মাঠে। আর একদিন সে নিঃসঙ্গ হতে থাকে। তার ক্ষুধা এক নারীর । পথ দিয়ে যাবার সময় দু’-এক জনকে বলেছেও তার জন্য যেন একটা মেয়ে দেখে তারা। খুব সুখের জীবন তার। একদিন অপরাহ্ণে হাজির হয় এক আগন্তুক নারী। নাম তার ইঙ্গার। প্রথম দিকে বোঝা যায় না । পরে বোঝা যায় তার উপরের ঠোঁট চেরা। এ-কারণে তাকে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে জীবনে। ঠোঁট চেরার কারণে তার বিয়ে হয়নি এতদিন। রাতে তাকে গ্রহণ করে আইজাক। এভাবে তারা বাধা পড়ে যৌথজীবনে। ইঙ্গার কর্মঠ নারী। তারা গড়ে তোলে খামার। গরু-ছাগল নিয়ে একটা ভরান্ত পরিবার। আবাদী জায়গাটার একটা নামও দিয়ে দেয় তারা : সেলেনারা। তাদের কোল জুড়ে আসে ইলিসিমা আর সিভার্ট। আইজাক আর ইঙ্গার এখন দুই পুত্রসন্তানের জনকজননী।
তৃতীয় সন্তান পেটে । ইঙ্গারের একটাই ভয় — তার উপরের ঠোঁট চেরা। এখন ছেলে-মেয়ে হলে যদি তারও ঠোঁট চেরা হয়? ইঙ্গার নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছে অঙ্গহীন জীবনের দুঃখযন্ত্রণা। এজন্য তার বিয়ে হয়নি। কাউকে ভালোবাসার সাহস হয়নি তার — যদি তার প্রেমিক তাকে ঘৃণা করে? তৃতীয়বারের মতো তার একটা মেয়ে হয় এবং তার উপরের ঠোঁট চেরা। প্রতিবেশীরা এল দেখতে। কী লজ্জা! সকলে চলে যেতে ইঙ্গার একটা ভীষণ কাণ্ড করে বসল। সে যেমন সারা জীবন ধরে উপহাস আর যন্ত্রণা পেয়েছে, তার মেয়ে যেন তা না পায়। মেয়েটাকে গলা টিপে হত্যা করে বনের ধারে পুঁতে রেখে আসে। এক নিষ্পাপ শিশুর নির্জন কবর। ওদিকে আইজাক ব্যস্ত থাকে খুব কাজে-কর্মে। কিন্ত এক প্রতিবেশিনী কবর থেকে মেয়েটার লাশ নিয়ে সদরে ইঙ্গারের বিরুদ্ধে মামলা টুকে দেয়। এতে আট বছরের সাজা হয়ে যায় ইঙ্গারের।
এভাবেই এগোতে থাকে এ-উপন্যাসের কাহিনী। শেষে জেলে ইঙ্গারের আরেকটা মেয়ে হয়। তারও ঠোঁট চেরা। কিন্ত এবারে ডাক্তার অপারেশন করে তার ঠোঁট ঠিক করে দেয়। এরপর আইজাকের জমিতে তামার খনি পাওয়া যায়। আইজাক জমি বিক্রি করে দেয়। এতে তার প্রচুর লাভ হয়। শেষে ইলিসিমা শহরে চলে যায়। সে সেখান থেকে আমেরিকা পাড়ি জমায়। আর সেভার্ট বাবার মতো চাষবাস করে থেকে যায় গ্রামে। কী আশ্চর্য সুন্দর এই সেলেনারা! এখানে আকাশ আর মৃত্তিকা অবারিত। সেভার্ট ভালোবেসে ফেলে এই অঞ্চলকে। কেবল চাষবাসে নয়, নগর সভ্যতারও বিকাশ ঘটেছে এ-এলাকায়। তামার খনি আবিষ্কারের সাথে সাথে আধুনিক বিজ্ঞান যে-বলিষ্ঠ পদক্ষেপ রাখছে, তাকেও অস্বীকার করার উপায় নাই। সভ্যতা যতই এগিয়ে আসুক, মানুষকে তো তবুও নতুন আবাদ করতে হয়। সমস্ত উপন্যাসে একটা অদ্ভুত মহাকাব্যিক আবহ ধরে রাখে পাঠককে।
নুট হামসুন ১৮৫৯ সালে ৪ আগস্ট অত্যন্ত দরিদ্র এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। খুব কম বয়সে বাবা মারা যান। পরিবারে লেখাপড়ার তেমন কোনো চল ছিল না। হামসুন স্কুলশিক্ষাও তেমন কিছু পাননি। চাষ ছাড়াও আরেকটা কাজ তিনি শিখেছিলেন : জুতা তৈরি। যে-ওস্তাদের কাছে হামসুন কাজ শিখতেন, তাঁর কাছে অনেক বড় বড় লোক আসতেন। তাঁদের দেখে দেখে হামসুন অনেক বড় হবার স্বপ্ন দেখেন। তিনি বুঝলেন, বড় হতে হলে লেখাপড়া দরকার। হামসুন স্কুলের কিছু পাঠ্যসূচি জোগাড় করে পড়তে লাগলেন। হামসুন বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী ছিলেন। তিন বছরের কোর্স এক বছরে শেষ করলেন। একটা কেরানির চাকরিও জুটে যায়। পোষাল না, হলেন স্কুল মাস্টার। নিয়মিত পড়তে থাকেন। অবশ্য সাহিত্য। মাঝে মাঝে কবিতা লেখেন, পত্রিকায় পাঠান। দু’-একটা ছাপাও হয়। ইচ্ছে হল লেখক হবেন। ক্রিশ্চিনা শহরে এসে চেষ্টা করতে থাকেন। বহু কষ্টে জীবন ধারণ করেন। চলে গেলেন আমেরিকা। সেখানে বাগানের মজুর, মাছ ধরার জেলে, গমক্ষেতে, রাস্তা মেরামতের কুলি, কয়লা ভাঙার মজুর, ট্রামের কন্ট্রাকটরি ইত্যাদি কাজ করতে লাগলেন। কিন্ত সময় পেলেই বই খুলে বসেন। একদিন এমনি কাজের ফাঁকে গ্রিক নাটক পড়ছিলেন। কাজ ফাঁকি দেবার অভিযোগে চাকরি খতম।
আবার শুরু হল ক্ষুধার সাথে সংগ্রাম। অনাহার আর অর্ধাহার। একদিন না কি কুকুরের নাম করে কসাইয়ের কাছ থেকে একটা হাড় চেয়ে নেন। তাতে একটু মাংস লেগে আছে কি না। হাড়টা নিয়ে একটা গলিতে ঢুকে পড়েন। কামড় লাগান — উফ, কী বিচ্ছিরি গন্ধ! তাও সহি। এই হচ্ছেন নুট হামসুন। এই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগান তিনি, লেখেন তাঁর সবচাইতে বিখ্যাত উপন্যাস হাঙ্গার। এই বই লিখতে গিয়ে না খেয়ে হামসুন একেবারে শুকিয়ে কাঠি। জরাজীর্ণ পোশাক। হামসুন পান্ণ্ডুলিপিটা নিয়ে পলিটিক্যাল পত্রিকার নামজাদা সম্পাদক এডওয়ার্ড ব্রাওসের সঙ্গে দেখা করেন। অভিজাত ও ঐশ্বর্যের গর্বে গর্বিত এই লোক। হামসুনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকান। সরাসরি অবশ্য বিদায় করলেন না। পাণ্ডুলিপিটা দয়া করে রাখলেন। তারপরে পড়ে অবাক। হাঙ্গার প্রকাশিত হতে থাকল। মাটির কাছাকাছি থাকা কবির প্রথম জয়যাত্রা শুরু।
নুট হামসুন নোবেল পুরস্কার লাভ করেন ১৯২০ সালে। অনেক সমালোচকই তাঁর নাজি কানেকশন নিয়ে তাঁর উপর ক্ষ্যাপা, তবে সেটা আলাদা অধ্যায়। ১৯৫২ সালে এই মহান লেখক দেহত্যাগ করেন।

মারগুরিত দ্যুরাজ সর্ম্পকে প্রাসঙ্গিক

ফরাসি নিউ ওয়েভ চলচ্চিত্র গোষ্ঠীর অন্যতম মেধাবী চলচ্চিত্রকার আলা রেনের ‘হিরোশিমা মন আমুর’ মুভিটা দেখে জন্মানো আগ্রহ থেকে প্রথম জানতে পারি মারগুরিত দ্যুরাজ সর্ম্পকে। দ্যুরাজ ছবিটার লেখক ছিলেন। ছবিটার লেখক হিসেবে কানে ও বার্লিনে তিনি যথেষ্ট সম্মানও পেয়েছেন। পরে তিনি নিজেও বেশকটি ছবির পরিচালনা করেছেন। যদিও তাঁর পরিচালিত কোনো ছবি দেখার এখনব্দি সৌভাগ্য হয় নাই। L’Amant ( লাঁম বা প্রেমিক) তার আত্মজীবনী মুলক এই ফিকশনটার গোপনে গোপনে প্রতীক্ষায় ছিলাম বলা চলে। বইটির খোঁজ কারো কাছে পাই নাই। জানতামও না কলকাতার এবং মুশায়েরা থেকে বইটার অনুবাদ বেরিয়ে গেছে। যাইহোক নারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের মুল ফরাসী থেকে অনুদিত এই ছোট বইটি শাহবাগে পেয়ে গেলাম। দ্যুরাজের  প্রতি দুর্দান্ত টানের কারণে বইটা কিনলেও পাতা উল্টিয়ে দেখা গেল প্রথম পৃষ্ঠাটা টানছেনা। যে বই প্রথমেই তার সঙ্গী করেনা তার কাছে ফিরে আসতে সময় লাগে। কেননা একসাথে বেশকটি বই পড়ার লিস্টে থাকে।
লামঁ-মারগুরিত দ্যুরাসের এই বইটি কেনার পর তিন তিনবার ব্যর্থ হয়ে ভেবেছি টাকাটা জলে গেল নাতো। বইটা এতো সুন্দর ছোট মনে হয় সব কাজকামের আগে এইটা শেষ করে নেই। কিন্তু তিন তিনবার ব্যর্থ হবার পর দেখা গেল ইতোমধ্যে বাকী বইগুলো খতম। পয়সা হাসিল করার মানসিকতা নিয়ে আবার পড়তে থাকি।
এবার  মারগুরিতের ভাষায় বলতে হয় এযে নিরাকার সমুদ্র।
সেটা ছিল ফরাসিদের উপনিবেশ বিস্তারের সময়কাল। ইন্দোচীন তথা বর্তমানের ভিয়েতনাম এ নভেলের পটভূমি। উপনিবেশ শেষ হয়ে যাবার পরও বিভিন্ন সমস্যায় আটকে থাকা একটি পরিবার। দায় দেনায় জর্জরিত। মাষ্টারনি গৃহকর্ত্রী যার স্বামী সদ্যগত। দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলেটি মায়ের প্রশ্রয়ে নস্ট, যে নিজের ভাইবোনের কাছে সবসময় অত্যাচারী সম্রাট। আর পনের বছরের তুলতুলে মিষ্টি মেয়েটি যে কিনা বেরিয়ে পড়তে চাইল এই অসহ্য এক ঋতুর গ্রীষ্মের দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও অথবা ফ্রান্সের দিকে। মা তাকে জিজ্ঞেস করে কি তুমি করতে পারো? আর সে বলে।
তাকে আমি বলেছিলাম যে লিখতে চাই। যা কিছু চাই তার মধ্যে সব চাইতে বেশী চাই লেখক হতে আর কিছু হতে চাইনা।
তার সহ্য হলোনা। একনজর থাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল। কাধের একটা ছোট্ট ঝাঁকুনি। ভোলা যায়না। আমিই প্রথমে চলে গেলাম। আমাকে খোয়াবার আগে আমার মাকে আরও বছর খানেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল। আমাকে খোয়াবার জন্য এই বাচ্চাটাকে হারাবার আগে। ছেলেদের জন্য তার ভয় ছিল না। কিন্তু এটা সে জানত চলে যাবে, এ বেরিয়ে যেতে পারবে। ক্লাসে ফরাসিতে ফার্স্ট। মাস্টার মশাই মাকে বলেছিলেন-ক্লাসে আপনার মেয়ে ফরাসিতে সবচাইতে সেরা। আমার মা কিছু বলল না। কিছু না। মোটেই খুশি নয় সে কারন তার তার ছেলেরা ফরাসিতে প্রথম হয়না। নোংরা আর মিষ্টি মা আমার জিজ্ঞাসা করল, আর অংকে? উত্তর হল- এখনও নয় তবে হবে। মা জিজ্ঞাসা করল: কবে হবে?
উত্তর হল- ও যখন চাইবে।
কিন্তু না সে অংকে সেরা হতে চায়নি। সে চেয়েছিল লিখতে, লেখক হতে। মা বলেছিল লেখাটা কোনো কাজই না। আর সে বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ী থেকে। এরপর মেকং নদী পার হবার বজরায় এক চিনের সাথে তার পরিচয় যে কিনা কিছু দিন আগে ফ্রান্স থেকে ফিরেছে। বজরা ডাঙ্গায় ভিড়লে সে বলেছিল আমার লিমুজিনে যাবে তোমাকে পৌঁছে দেব। মেয়েটি তাকে অনুসরণ করলো। এরপর তার সাথে জড়িয়ে পড়ে মেয়েটি। এরপর ক্রমে সে আসক্ত হয়ে পড়ে মাদকে আর সমকামিতায়। মোট কথা সমস্ত প্রথা ভেঙ্গে সে ক্রমে ব্যক্তি হয়ে ওঠে। মোট কথা ৬০ পৃষ্ঠার ছোট এ উপন্যাসটা উপন্যাসেরও সমস্ত ফর্ম ভাঙ্গার উপন্যাস হয়ে ওঠে। কিন্তু অদ্ভুত আন্তরিক আত্মা ও রক্ত দিয়ে লেখা। চৈতন্যকে এক জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসে।
ফরাসী লামঁ শব্দের অর্থ প্রেমিক। মারগুরিত জন্মেছিলেন ইন্দোচীনে ১৯১৪ সালে। মৃত্যু ১৯৯৬ সালে। এ বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। এ উপন্যাস শুধু যে ফরাসি বিখ্যাত পুরস্কার গঁক্যুর বাগিয়ে নিল তা নয়। দ্যুরাসকে দিয়েছে ৩ মিলিয়ন বিক্রিত বইয়ের লেখিকার সম্মান। পৃথিবীর অন্তত ৪০ টি ভাষায় অনুদিত। জাঁ জাক আনো এটি চলচ্চিত্র রূপ দেন। বলা যায় এটি নিয়ে শুরু হয় ফরাসি সাহিত্যের NOUVEAU ROMAN বা নব-উপন্যাস আন্দোলন। পুরা উপন্যাসটায় কোনো ধারাবাহিকতা নাই। কিন্তু কেমন যেন গুছানো। বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার বহু বহু দিন পর চিনে লোকটি তার নববধূ সহ পারিতে এলে একদিন ফোন করে মেয়েটিকে বলে: আমি শুধু তোমার কন্ঠস্বর শুনতে চেয়েছিলাম। যদিও তাদের প্রেমটায় দেহ ছাড়া অন্য কিছু ছিলনা। অনেক পরে তারা বুঝতে পারে সে আসলে তারা পরস্পরের প্রেমে পড়েছিল। সার্ত্র আর মালার্মে সহ তৎকালীন পারির লেখকরা ওঠে আসে বিভিন্ন অধ্যায়ে।

পদ্মার পলিদ্বীপ: দ্বীপদেশের মহাকাব্য

শাস্ত্র মতে উপন্যাস মহাকাব্যের বংশধর। মহাকাব্যকে বলা যায় সাহিত্যের মাতৃক্রোড়। একদা মহাকাব্য চারণ কবিগণ মুখে মুখে আওড়াতেন। রাজা ও প্রজা যাকে নিয়েই রচিত হোক, মহাকাব্যগুলোতে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়- মাত্রাঐক্য। একই আবহের মধ্যে দিয়ে যেন ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে যায়। কোথাও এতটুকু বেতাল হচ্ছে না। সন্দেহ নাই সুর কেটে গেলে সেটা মহাকাব্য হিসাবে অসফল।
ধারাবাহিকতা, কাহিনীর সমন্বিত বিস্তার, সময়োপযোগী ডিটেল ও ভাষার ব্যবহারই মূলত একই লয়ে তাকে ধরে রাখে। শালোকভের বয়ানে-উপন্যাসিকদের সঙ্গীত জ্ঞান জরুরী। সব সফল মহৎ উপন্যাস গুলোতে এই মহাকাব্যের গভীরতা বিদ্যমান। মহাত্মা বালজাক এই কারণে তার উপন্যাসমালার নাম রাখেন হিউম্যান কমেদিয়া। এই উপন্যাসমালার প্রতিটি উপন্যাস মিলে যেন একটা মহাকাব্য। ফরাসী সমাজের সব ধরনের চরিত্র তাতে বিদ্যমান। শালোকভের বৃহৎ উপন্যাস প্রশান্ত দনে শত চরিত্রের ঘনঘঠা বহু ঘটনার বিস্তার। বলা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রুশীয় গৃহযুদ্ধ থেকে অক্টোবর বিপ্লব পর্যন্ত, কিন্তু পুরা উপন্যাসের পরতে পরতে যেন একই ধারার সঙ্গীত বেজে চলেছে। কখনোই কেন্দ্রচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়তে হয়না পাঠককে।
তলস্তয়ের মহাকাব্যিক উপন্যাসসমূহ আনা কারেনিনা, পুনরুজ্জীবন। দস্তয়েভস্কির কারামাজভ ভাইয়েরা, অপরাধ ও শাস্তি অথবা স্তাদালের লাল ও কালো। মহাকাব্যর একটা পর্যায় ছিল যখন তা লিখিত হতো  দেব দেবীদের নিয়ে। নিদেন পক্ষে রাজা বাদশা আমির ওমরাহদের নিয়ে।
কেননা রাজাবাদাশাহরাই ছিলেন তৎকালে কবিদের  পৃষ্টপোষক।
কিন্তু ইতোমধ্যে মানুষ যুদ্ধে, ভূমিকম্প,অগ্ন্যুৎপাত, রোগে, মহামারীতে নিজের অভিজ্ঞতাতো সম্মৃদ্ধ করলোই তদোপরি নিজের সীমাটাকে সে নির্ধারণ করতে পারলো। চিহ্নিত করতে পারলো তার অসহায়ত্বকে। এমনকি তলস্তয়ের চরিত্র সমূহ নেখলেয়ুদভ অথবা কনস্তানতিন লেভিন, ব্রনস্কি, কারেনিন অথবা পিটার, সুফিয়া প্রায় সব চরিত্র ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি বইতো নয়! প্রলেতারিয়েত চেতনা থাকা সত্বেও লেভিনও তাই। যাইহোক আধুনিক কালের উপন্যাসই মহাকাব্যের বংশধর হিসাবে উত্তম। বিশ্বসাহিত্যে সম্ভবত দস্তয়েভস্কিই সেই মহৎ উপন্যাসিক যার শুরু থেকেই চরিত্ররা একেবারে সাধারণ মানুষ।
দস্তয়েভস্কি গোগল সম্পর্কে বলেছিলেন গোগলের ওভারকোট এর পকেট থেকে আধুনিক রুশ সাহিত্যের জন্ম। দস্তয়েভস্তি সম্পর্কেও বলা যায় যে আধুনিক উপন্যাসেরও জন্ম তার রাসকলনিকভে। তার চরিত্র সমূহে। কার্যত দস্তয়েভস্কি ও বালজাকের পর উপন্যাস আর আগের মত থাকে নাই। ব্রাত্য অন্তর্মুখী অভাজনেরাই আধুনিক মহাকাব্য তথা উপন্যাসে প্রধান চরিত্র হয়ে আসতে লাগল। এবং উপন্যাসে সাধারণ মানুষের স্থান বলা যায় চিরস্থায়ী হয়ে গেল। যদিও এই সাধারনত্বের গোত্রভিত্তিক রূপ দিতে গিয়ে প্রকৃতিবাদি এমিল জোলা, কুপ্রিন, মপাসা প্রমুখ উপন্যাসকে প্রায় পর্ণের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মহৎ উপন্যাসিক সময় উপত্যাকার চারিদিকে আধ্যাত্বিক পরিভ্রমণরত। সমস্ত বিষয়টিকে, যে বিষয় নিয়ে সে কাজ করে, মানসচক্ষে দেখতে পায় বলে একটা মাত্র কাহিনীতে তাকে ধরে রাখতে পারে।
আবু ইসহাকের পদ্মার পলিদ্বীপ বইটির আলোচনা করতে গিয়ে উর্ধ্বাংশর ভুমিকাটুকুর অবতারণা করতে হল কেননা এই বইটি মহাকাব্যের লক্ষনাক্রান্ত। বইটি পড়তে পড়তে শালোকভের  প্রশান্ত দনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার। একজন মহৎ ও পাক্কা ঔপন্যাসিকের সবগুণে আবু ইসহাক গুণান্বিত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত অধিকাংশ গল্পই অরুচিকর নিম্নমানের হয়। আবু ইসহাকে জোক গল্পটি মাধ্যমিকে পাঠ্য ছিল একসময় কিন্তু সিলেবাসভূক্ত ছিল না। কৈশোরে এই গল্পটি পড়েই বুঝতে পেরেছিলাম আবু ইসহাকের লেখনীরে শক্তি।
আবু ইসহাকের সাহিত্যকর্ম মোট পাঁচটি বইয়ে সীমাবদ্ধ। মহাপতঙ্গ, হারেম, সূর্যদীঘল বাড়ি, পদ্মার পলিদ্বীপ ও জাল।
পদ্মাপারের জেগে উঠা চরের মতই দ্বীপাঞ্চলের অনিশ্চিত মানুষের গল্প লেখেন তিনি। পদ্মাপারের মাটির মানুষ আর তাদের ভাষা আর তাদের ভেতর দিয়ে উপনিবেশবাদের অক্টোপুশি চেহারাকেই তিনি উন্মোচিত করেন। এ উপন্যাসের নায়ক ফজলের মতই যেন তৃতীয় বিশ্ববাসি।
ফজল একদিন মাছ ধরতে গিয়ে দেখতে পায় তাদের পুরানা দখলকৃত খুনের চর আবার জেগে উঠেছে। সে তার বাবা মাতব্বরকে খবর দেয়। কোলশরিকদের নিয়ে মাতব্বর চরটি পুন:দখল করে।
কিন্তু উপনিবেশবাদি জাঙ্গরুল্লা চরটি দখল করার পায়তারা করে। তার অভিনব কৌশলের কাছে সহজেই পরাস্ত হয় ফজলরা। চরের পাশে একটি ডাকাতি হয়েছে এই মর্মে থানায় এজাহার দেয় জাঙ্গরুল্লা। জাঙ্গরুল্লার পয়সা খাওয়া পুলিশ বাহিনী মিথ্যা মামলার আসামী করে ফজলকে। ফজলরা পালিয়ে গেলে দ্রুত চরটির দখল নেয় জাঙ্গরুল্লা। অন্যান্য উপনিবেশবাদিদের মতই জাঙ্গরুল্লা এক পিরকে ধরে এনে ধর্ম প্রচারের আস্তানা গড়তে চায় এই চরে।
আবু ইসহাক পদ্মার পলিদ্বীপ রচনা করেন ১৯৮৬ সালে। ততদিনে মার্কিন সাম্রাজ্য বিকশিত হয়ে ডালপালা গজিয়েছে। তিনি জানেন সাম্রাজ্যবাদীরা নব নব পন্থায় সাম্রাজ্য বিস্তারের পায়তারা করে। আবার এই জুলুম কে জায়েজ করার জন্য তাদের দরকার হয় ধর্মীয় নৈতিকতার আধার। হিংসার চরমতম রূপ যুদ্ধকে তারা নাম দেয় ক্রুসেড। তারা লুন্ঠনকে করে তোলে ধর্মপ্রচারের সফর। চিরদিন এই দুটি ব্যাপার একই মুদ্রার এপিট ওপিট হিসেবে চলে আসছে।  লেখকের অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা বয়ানের সত্যতা এ উপন্যাসের জাঙ্গরুল্লা চরিত্রটি বিশ্লেষণ করলে মেলে। বুঝা যায় উপনিবেশ বাদিতা অশেষ। উপনিবেশবাদিতা প্রজাতির রক্তিম বৈশিষ্ট। প্রতিটি মানুষের ভিতর রয়েছে রাজত্ব করবার  বৈশিষ্ট। দখলপ্রবৃত্তি মানুষের অতি পুরাতন বাসনা। যা কিছু আনন্দ দেয়, শৌর্য দেয়, বীর্যবান করে সবই তার দখলে চায়। জাঙ্গরুল্লার দখলে অনেক চর। তার অনেক লাঠিয়াল, অনেক শক্তি। বহু মিত্র, কোলশরিক। তবু যেই শুনেছে খুনের চরে ভাল ধান হচ্ছে। খুনের চর থেকে মাছ ধরে সহজে দুই পয়সা কামাই করা যায়। তখনই তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে লোভ, তার ঘুম হারাম হয়ে যায়। কী উপায়ে এই দ্বীপ দখল করা যায়। এটাই তো সাম্রাজ্যের মন। যখন মানুষের দখলসত্তা জেগে ওঠে তখন সে একটার পর একটা পরিকল্পনা করে, কিভাবে সে তা দখল করতে পারে। এই জন্য সে মিছা ডাকাতির মামলা সাজায়। ফজল ধরা পড়ে জেলে যায়। সাক্ষী জাঙ্গরুল্লার লোকজন আর তার মতা আর তার টাকা।
পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত সাম্রাজ্যবাদীদের উত্থান ঘটেছে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় প্রত্যেক দখলদারিত্বের আগে তারা মিথ্যাচারের জন্য নগ্নভাবে মিড়িয়াকে ব্যবহার করে। এডওয়ার্ড সাঈদের কাভারিং ইসলাম ও আফটার দ্যা লাস্ট স্কাই বইসমূহ  এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বিবিসি, সি এন এন এর মত নিউজ ব্রডকাস্টিংগুলোকে নিজেদের স্বার্থে পশ্চিমারা কি জঘন্যভাবে ব্যবহার করে বইগুলো তার সাক্ষ্য দেয়। এই কিছুদিন আগেও নিউজ এজেন্সিগুলোর বরাতে সাদ্দাম হোসেনকে মনে হত বিশ্বত্রাস। যে কোনো মুহূর্তে দুনিয়াকে নরকে নিয়ে যাবার মতা যেন তার রয়েছে। ভাবখানা ছিল এমন। কত সহজেই না মার্কিনিরা ইদুরের মত লেজ ধরে গর্ত থেকে তুলে এন লটকে দিল ফাঁসিতে।  এই যে ওসামা বিল লাদেন কে খোঁজার নামে কাবুলকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রস্তর যুগে। সন্দেহ হয় আসলে ওসামা বিল লাদেন বলে কেউ আছে কি ? যে মার্কিনিদের বোমা বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে পাহাড়ে খানাখন্দে তেলাপোকার মত বেঁচে আছে। এই সবই কি উপনিবেশ বিস্তারের বা বিস্তারিত উপনিবেশকে পোক্ত করার জন্য অভিনব কৌশল নয়? আসলে ঘঠনা পরম্পরা বিবেচনা করলে দেখা যায় সবকিছুর মুলে চরদখল।
মাছ ধরতে গিয়ে নদীতে মরে যায় জরিনার স্বামী অসুস্থ চোর মতলব। এতবড় ইস্যু কি ছাড়তে পারে জাঙ্গরুল্লা। সে রটায় ফজলই খুন করেছে মতলবকে। উপন্যাসের শেষার্ধে যদিও উপন্যাসিক ফজলকে দিয়ে পুনরায় দখল করায় খুনের চর। কিন্তু মানুষকি আদৌ এত আশাবাদি হতে পেরেছে? জাঙ্গরুল্লার কোলশরিক ফজলের শ্বশুর যখন ফজলের বউ রূপজানকে বিভিন্ন ছুতোয় আটকে রাখে নিজের বাড়ীতে। তখন ফজলই বুদ্ধি করে জাঙ্গরুল্লার লোক সেজে রূপজানকে তুলে নিয়ে আসে। এটাই আসলে টিকে থাকার মেটাফর। ফজল-জরিনা-রূপজান কেন্দ্রিক প্রেম কাহিনীটা এ উপন্যাসকে আরো বেশি চিরন্তন করে তোলে।
প্রসঙ্গত জাল উপন্যাসে আবু ইসহাক একটা  ভুমিকা লেখেন। তার ভাষায় আমার প্রথম উপন্যাস সুর্যদীঘল বাড়ি লেখা শেষ হয় ১৯৪৮ সালের আগষ্ট মাসে। তারপর চার-চারটে বছর প্রকাশকের সন্ধানে কলকাতা ও ঢাকায় ঘোরাঘুরি করেও বইটির প্রকাশক পাইনি। এত আহত হয়ে তিনি ভাবলেন মৌলিক উপন্যাস যখন কেউ ছাপেনা  ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখবেন। এরই ফলশ্রুতিতে তিনি জাল লেখেন। কিন্তু পাঁচবছরের মাথায় তিনি সুর্যদীঘল বাড়ির প্রকাশক পান এবং এটার সফলতা দেখে জাল এর পান্ডুলিপি বাক্সবন্দি করেন। প্রায় ৩৪ বছর জাল এর পান্ডুলিপি বাক্সবন্দি অবস্থায় ছিল। বাংলাদেশের প্রকাশকদের মত অশিক্ষিত কোনো সম্প্রদায় নাই। এদের কারণে বলা যায় ব্যবসা চিন্ত আর নোংরা মানসিকতা আর সস্তা রুচির কারণে এ দেশিয় সাহিত্য এখনো আতুড় ঘরেই রয়ে গেল। এখনো যে দেশে বই ছাপা হবার যোগ্যতা হচ্ছে আমলা হওয়া, পত্রিকার সম্পাদক হওয়া অথবা প্রকাশকের বউয়ের ভাই হওয়া। এদের হাতেই বন্দি এ দেশিয় সাহিত্য। মেলা আসলেই দেখা যায় এই মুর্খ অশিক্ষিত প্রকাশকদের কুরুচিপুর্ণ নিম্নমানের অপন্যাসে ভরে যায় বটতলার বইয়ের স্টলগুলো। এদের দৌরাত্ব্য ও নিষ্ঠুরতার বলি হয় আবু ইসহাকের মত মৌলিক অর্ন্তদৃষ্টি সম্পন্ন লেখকরা।