Wednesday, December 16, 2009

পদ্মার পলিদ্বীপ: দ্বীপদেশের মহাকাব্য

শাস্ত্র মতে উপন্যাস মহাকাব্যের বংশধর। মহাকাব্যকে বলা যায় সাহিত্যের মাতৃক্রোড়। একদা মহাকাব্য চারণ কবিগণ মুখে মুখে আওড়াতেন। রাজা ও প্রজা যাকে নিয়েই রচিত হোক, মহাকাব্যগুলোতে একটা ব্যাপার লক্ষ্যণীয়- মাত্রাঐক্য। একই আবহের মধ্যে দিয়ে যেন ঘটনাপ্রবাহ এগিয়ে যায়। কোথাও এতটুকু বেতাল হচ্ছে না। সন্দেহ নাই সুর কেটে গেলে সেটা মহাকাব্য হিসাবে অসফল।
ধারাবাহিকতা, কাহিনীর সমন্বিত বিস্তার, সময়োপযোগী ডিটেল ও ভাষার ব্যবহারই মূলত একই লয়ে তাকে ধরে রাখে। শালোকভের বয়ানে-উপন্যাসিকদের সঙ্গীত জ্ঞান জরুরী। সব সফল মহৎ উপন্যাস গুলোতে এই মহাকাব্যের গভীরতা বিদ্যমান। মহাত্মা বালজাক এই কারণে তার উপন্যাসমালার নাম রাখেন হিউম্যান কমেদিয়া। এই উপন্যাসমালার প্রতিটি উপন্যাস মিলে যেন একটা মহাকাব্য। ফরাসী সমাজের সব ধরনের চরিত্র তাতে বিদ্যমান। শালোকভের বৃহৎ উপন্যাস প্রশান্ত দনে শত চরিত্রের ঘনঘঠা বহু ঘটনার বিস্তার। বলা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ,দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, রুশীয় গৃহযুদ্ধ থেকে অক্টোবর বিপ্লব পর্যন্ত, কিন্তু পুরা উপন্যাসের পরতে পরতে যেন একই ধারার সঙ্গীত বেজে চলেছে। কখনোই কেন্দ্রচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়তে হয়না পাঠককে।
তলস্তয়ের মহাকাব্যিক উপন্যাসসমূহ আনা কারেনিনা, পুনরুজ্জীবন। দস্তয়েভস্কির কারামাজভ ভাইয়েরা, অপরাধ ও শাস্তি অথবা স্তাদালের লাল ও কালো। মহাকাব্যর একটা পর্যায় ছিল যখন তা লিখিত হতো  দেব দেবীদের নিয়ে। নিদেন পক্ষে রাজা বাদশা আমির ওমরাহদের নিয়ে।
কেননা রাজাবাদাশাহরাই ছিলেন তৎকালে কবিদের  পৃষ্টপোষক।
কিন্তু ইতোমধ্যে মানুষ যুদ্ধে, ভূমিকম্প,অগ্ন্যুৎপাত, রোগে, মহামারীতে নিজের অভিজ্ঞতাতো সম্মৃদ্ধ করলোই তদোপরি নিজের সীমাটাকে সে নির্ধারণ করতে পারলো। চিহ্নিত করতে পারলো তার অসহায়ত্বকে। এমনকি তলস্তয়ের চরিত্র সমূহ নেখলেয়ুদভ অথবা কনস্তানতিন লেভিন, ব্রনস্কি, কারেনিন অথবা পিটার, সুফিয়া প্রায় সব চরিত্র ধনতন্ত্রের প্রতিনিধি বইতো নয়! প্রলেতারিয়েত চেতনা থাকা সত্বেও লেভিনও তাই। যাইহোক আধুনিক কালের উপন্যাসই মহাকাব্যের বংশধর হিসাবে উত্তম। বিশ্বসাহিত্যে সম্ভবত দস্তয়েভস্কিই সেই মহৎ উপন্যাসিক যার শুরু থেকেই চরিত্ররা একেবারে সাধারণ মানুষ।
দস্তয়েভস্কি গোগল সম্পর্কে বলেছিলেন গোগলের ওভারকোট এর পকেট থেকে আধুনিক রুশ সাহিত্যের জন্ম। দস্তয়েভস্তি সম্পর্কেও বলা যায় যে আধুনিক উপন্যাসেরও জন্ম তার রাসকলনিকভে। তার চরিত্র সমূহে। কার্যত দস্তয়েভস্কি ও বালজাকের পর উপন্যাস আর আগের মত থাকে নাই। ব্রাত্য অন্তর্মুখী অভাজনেরাই আধুনিক মহাকাব্য তথা উপন্যাসে প্রধান চরিত্র হয়ে আসতে লাগল। এবং উপন্যাসে সাধারণ মানুষের স্থান বলা যায় চিরস্থায়ী হয়ে গেল। যদিও এই সাধারনত্বের গোত্রভিত্তিক রূপ দিতে গিয়ে প্রকৃতিবাদি এমিল জোলা, কুপ্রিন, মপাসা প্রমুখ উপন্যাসকে প্রায় পর্ণের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
মহৎ উপন্যাসিক সময় উপত্যাকার চারিদিকে আধ্যাত্বিক পরিভ্রমণরত। সমস্ত বিষয়টিকে, যে বিষয় নিয়ে সে কাজ করে, মানসচক্ষে দেখতে পায় বলে একটা মাত্র কাহিনীতে তাকে ধরে রাখতে পারে।
আবু ইসহাকের পদ্মার পলিদ্বীপ বইটির আলোচনা করতে গিয়ে উর্ধ্বাংশর ভুমিকাটুকুর অবতারণা করতে হল কেননা এই বইটি মহাকাব্যের লক্ষনাক্রান্ত। বইটি পড়তে পড়তে শালোকভের  প্রশান্ত দনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল বারবার। একজন মহৎ ও পাক্কা ঔপন্যাসিকের সবগুণে আবু ইসহাক গুণান্বিত।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত অধিকাংশ গল্পই অরুচিকর নিম্নমানের হয়। আবু ইসহাকে জোক গল্পটি মাধ্যমিকে পাঠ্য ছিল একসময় কিন্তু সিলেবাসভূক্ত ছিল না। কৈশোরে এই গল্পটি পড়েই বুঝতে পেরেছিলাম আবু ইসহাকের লেখনীরে শক্তি।
আবু ইসহাকের সাহিত্যকর্ম মোট পাঁচটি বইয়ে সীমাবদ্ধ। মহাপতঙ্গ, হারেম, সূর্যদীঘল বাড়ি, পদ্মার পলিদ্বীপ ও জাল।
পদ্মাপারের জেগে উঠা চরের মতই দ্বীপাঞ্চলের অনিশ্চিত মানুষের গল্প লেখেন তিনি। পদ্মাপারের মাটির মানুষ আর তাদের ভাষা আর তাদের ভেতর দিয়ে উপনিবেশবাদের অক্টোপুশি চেহারাকেই তিনি উন্মোচিত করেন। এ উপন্যাসের নায়ক ফজলের মতই যেন তৃতীয় বিশ্ববাসি।
ফজল একদিন মাছ ধরতে গিয়ে দেখতে পায় তাদের পুরানা দখলকৃত খুনের চর আবার জেগে উঠেছে। সে তার বাবা মাতব্বরকে খবর দেয়। কোলশরিকদের নিয়ে মাতব্বর চরটি পুন:দখল করে।
কিন্তু উপনিবেশবাদি জাঙ্গরুল্লা চরটি দখল করার পায়তারা করে। তার অভিনব কৌশলের কাছে সহজেই পরাস্ত হয় ফজলরা। চরের পাশে একটি ডাকাতি হয়েছে এই মর্মে থানায় এজাহার দেয় জাঙ্গরুল্লা। জাঙ্গরুল্লার পয়সা খাওয়া পুলিশ বাহিনী মিথ্যা মামলার আসামী করে ফজলকে। ফজলরা পালিয়ে গেলে দ্রুত চরটির দখল নেয় জাঙ্গরুল্লা। অন্যান্য উপনিবেশবাদিদের মতই জাঙ্গরুল্লা এক পিরকে ধরে এনে ধর্ম প্রচারের আস্তানা গড়তে চায় এই চরে।
আবু ইসহাক পদ্মার পলিদ্বীপ রচনা করেন ১৯৮৬ সালে। ততদিনে মার্কিন সাম্রাজ্য বিকশিত হয়ে ডালপালা গজিয়েছে। তিনি জানেন সাম্রাজ্যবাদীরা নব নব পন্থায় সাম্রাজ্য বিস্তারের পায়তারা করে। আবার এই জুলুম কে জায়েজ করার জন্য তাদের দরকার হয় ধর্মীয় নৈতিকতার আধার। হিংসার চরমতম রূপ যুদ্ধকে তারা নাম দেয় ক্রুসেড। তারা লুন্ঠনকে করে তোলে ধর্মপ্রচারের সফর। চিরদিন এই দুটি ব্যাপার একই মুদ্রার এপিট ওপিট হিসেবে চলে আসছে।  লেখকের অন্তর্দৃষ্টির গভীরতা বয়ানের সত্যতা এ উপন্যাসের জাঙ্গরুল্লা চরিত্রটি বিশ্লেষণ করলে মেলে। বুঝা যায় উপনিবেশ বাদিতা অশেষ। উপনিবেশবাদিতা প্রজাতির রক্তিম বৈশিষ্ট। প্রতিটি মানুষের ভিতর রয়েছে রাজত্ব করবার  বৈশিষ্ট। দখলপ্রবৃত্তি মানুষের অতি পুরাতন বাসনা। যা কিছু আনন্দ দেয়, শৌর্য দেয়, বীর্যবান করে সবই তার দখলে চায়। জাঙ্গরুল্লার দখলে অনেক চর। তার অনেক লাঠিয়াল, অনেক শক্তি। বহু মিত্র, কোলশরিক। তবু যেই শুনেছে খুনের চরে ভাল ধান হচ্ছে। খুনের চর থেকে মাছ ধরে সহজে দুই পয়সা কামাই করা যায়। তখনই তার মাথায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে লোভ, তার ঘুম হারাম হয়ে যায়। কী উপায়ে এই দ্বীপ দখল করা যায়। এটাই তো সাম্রাজ্যের মন। যখন মানুষের দখলসত্তা জেগে ওঠে তখন সে একটার পর একটা পরিকল্পনা করে, কিভাবে সে তা দখল করতে পারে। এই জন্য সে মিছা ডাকাতির মামলা সাজায়। ফজল ধরা পড়ে জেলে যায়। সাক্ষী জাঙ্গরুল্লার লোকজন আর তার মতা আর তার টাকা।
পৃথিবীতে এ পর্যন্ত যত সাম্রাজ্যবাদীদের উত্থান ঘটেছে। ইতিহাস সাক্ষী দেয় প্রত্যেক দখলদারিত্বের আগে তারা মিথ্যাচারের জন্য নগ্নভাবে মিড়িয়াকে ব্যবহার করে। এডওয়ার্ড সাঈদের কাভারিং ইসলাম ও আফটার দ্যা লাস্ট স্কাই বইসমূহ  এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। বিবিসি, সি এন এন এর মত নিউজ ব্রডকাস্টিংগুলোকে নিজেদের স্বার্থে পশ্চিমারা কি জঘন্যভাবে ব্যবহার করে বইগুলো তার সাক্ষ্য দেয়। এই কিছুদিন আগেও নিউজ এজেন্সিগুলোর বরাতে সাদ্দাম হোসেনকে মনে হত বিশ্বত্রাস। যে কোনো মুহূর্তে দুনিয়াকে নরকে নিয়ে যাবার মতা যেন তার রয়েছে। ভাবখানা ছিল এমন। কত সহজেই না মার্কিনিরা ইদুরের মত লেজ ধরে গর্ত থেকে তুলে এন লটকে দিল ফাঁসিতে।  এই যে ওসামা বিল লাদেন কে খোঁজার নামে কাবুলকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে প্রস্তর যুগে। সন্দেহ হয় আসলে ওসামা বিল লাদেন বলে কেউ আছে কি ? যে মার্কিনিদের বোমা বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে পাহাড়ে খানাখন্দে তেলাপোকার মত বেঁচে আছে। এই সবই কি উপনিবেশ বিস্তারের বা বিস্তারিত উপনিবেশকে পোক্ত করার জন্য অভিনব কৌশল নয়? আসলে ঘঠনা পরম্পরা বিবেচনা করলে দেখা যায় সবকিছুর মুলে চরদখল।
মাছ ধরতে গিয়ে নদীতে মরে যায় জরিনার স্বামী অসুস্থ চোর মতলব। এতবড় ইস্যু কি ছাড়তে পারে জাঙ্গরুল্লা। সে রটায় ফজলই খুন করেছে মতলবকে। উপন্যাসের শেষার্ধে যদিও উপন্যাসিক ফজলকে দিয়ে পুনরায় দখল করায় খুনের চর। কিন্তু মানুষকি আদৌ এত আশাবাদি হতে পেরেছে? জাঙ্গরুল্লার কোলশরিক ফজলের শ্বশুর যখন ফজলের বউ রূপজানকে বিভিন্ন ছুতোয় আটকে রাখে নিজের বাড়ীতে। তখন ফজলই বুদ্ধি করে জাঙ্গরুল্লার লোক সেজে রূপজানকে তুলে নিয়ে আসে। এটাই আসলে টিকে থাকার মেটাফর। ফজল-জরিনা-রূপজান কেন্দ্রিক প্রেম কাহিনীটা এ উপন্যাসকে আরো বেশি চিরন্তন করে তোলে।
প্রসঙ্গত জাল উপন্যাসে আবু ইসহাক একটা  ভুমিকা লেখেন। তার ভাষায় আমার প্রথম উপন্যাস সুর্যদীঘল বাড়ি লেখা শেষ হয় ১৯৪৮ সালের আগষ্ট মাসে। তারপর চার-চারটে বছর প্রকাশকের সন্ধানে কলকাতা ও ঢাকায় ঘোরাঘুরি করেও বইটির প্রকাশক পাইনি। এত আহত হয়ে তিনি ভাবলেন মৌলিক উপন্যাস যখন কেউ ছাপেনা  ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখবেন। এরই ফলশ্রুতিতে তিনি জাল লেখেন। কিন্তু পাঁচবছরের মাথায় তিনি সুর্যদীঘল বাড়ির প্রকাশক পান এবং এটার সফলতা দেখে জাল এর পান্ডুলিপি বাক্সবন্দি করেন। প্রায় ৩৪ বছর জাল এর পান্ডুলিপি বাক্সবন্দি অবস্থায় ছিল। বাংলাদেশের প্রকাশকদের মত অশিক্ষিত কোনো সম্প্রদায় নাই। এদের কারণে বলা যায় ব্যবসা চিন্ত আর নোংরা মানসিকতা আর সস্তা রুচির কারণে এ দেশিয় সাহিত্য এখনো আতুড় ঘরেই রয়ে গেল। এখনো যে দেশে বই ছাপা হবার যোগ্যতা হচ্ছে আমলা হওয়া, পত্রিকার সম্পাদক হওয়া অথবা প্রকাশকের বউয়ের ভাই হওয়া। এদের হাতেই বন্দি এ দেশিয় সাহিত্য। মেলা আসলেই দেখা যায় এই মুর্খ অশিক্ষিত প্রকাশকদের কুরুচিপুর্ণ নিম্নমানের অপন্যাসে ভরে যায় বটতলার বইয়ের স্টলগুলো। এদের দৌরাত্ব্য ও নিষ্ঠুরতার বলি হয় আবু ইসহাকের মত মৌলিক অর্ন্তদৃষ্টি সম্পন্ন লেখকরা।

No comments:

Post a Comment