Thursday, April 11, 2013

চেতনান্ধ ফরহাদ মজহারের তালগাছ ও দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ


ফরহাদ মজহার স্বসম্পাদিত অনলাইন পত্রিকা 'চিন্তা'য় ‘হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করুন’ শিরোনামে একটা নিবন্ধ লিখেছেন। যা ফেসবুকের কল্যাণে অনেকের গোচরিভূত হয়েছে। ফরহাদ মজহারের এই নিবন্ধটি নানা কারণে গুরুত্ববহ, বিশেষ করে চিন্তা সরবরাহকারী বা চিন্তাবিক্রেতা হিসাবে তার অবস্থান ষ্পষ্ট করে আমাদের কাছে, আমরা যারা তার লেখা পাঠ করি। পুরা লেখাটা যুক্তিপূর্ণ চালাকিতে ভরা। যেন তিনি নিজের চেতনার দরজা জানলা বন্ধ রেখে এই লেখা লিখেছেন। কারণ তিনি শুধু নিজের তাল গাছটা চাইছেন। আর তাই ন্যায়ে'র সংজ্ঞাকে বিকৃত করেছেন ইচ্ছেমতো।

তার নিবন্ধের শুরুটা এরকম ‘ দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে পুলিশ যেভাবে মানুষ হত্যা করেছে তাকে নির্বিচার গণহত্যা ছাড়া মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের দিক থেকে আর কিছুই বলা যায় না।’
এই লাইনটা যে কেউ পড়লেই বুঝতে পারবেন লেখাটা সম্পূর্ণ স্বার্থান্ধ। বাংলাভাষা যারা শুনে বুঝতে বা পড়তে পারেন। প্রায় একমাস ধরে বাংলাদেশে যা হচ্ছে তারা তা অবগত আছেন। তারা লাইনটা এভাবে পড়তে চাইবেন। একাত্তরের পিচাশ, ধর্ষক, নরঘাতক, দেল্যা রাজাকারের ফাঁসির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে জামাত শিবির তাণ্ডব ও ধ্বংশযজ্ঞ শুরু করে, তা প্রতিরোধ করতে গিয়ে তারা মুহুর্মুহু পুলিশসহ সাধারণ জনগণকে আতংকিত করে তোলে। পুলিশের সাথে সরাসরি যুদ্ধ বাধায়। এই যুদ্ধে পুলিশ, পথচারী, শিবির সহ অনেকেই নিহত হয়েছেন।

তাইলে দেখা যাচ্ছে ফরহাদ মজহার কার্যকারণ সম্মন্ধটাকেই সরিয়ে দিয়েছেন।  যে কোনো মস্তিষ্কবিকৃতিহীন মানুষই প্রশ্ন করবে দেলোয়ারের রায় শুনে পুলিশ কেন মানুষ হত্যা শুরু করবে?  আর এই তৃমুখি লড়াইকে তিনি আখ্যায়িত করছেন ‘নির্বিচার গণহত্যা’ ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’। তাহলে এইখানে প্রশ্ন হয়া দাঁড়ায় ‘বিচার’ আর ‘মানবাধিকার’ বলতে তিনি কি জ্ঞান করেন? 

এই নিবন্ধেই তিনি বলছেন ‘পাবলিক লিঞ্চিং যেমন হতে পারে না, তেমনি যারা রায়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে তাদের নির্বিচার গুলি করাও আমরা সমর্থন করতে পারি না।’
১৯৭১ সালের ৩০ লাখ মানুষের হত্যাকারীদের বিচার দাবি তার কাছে বিচার না নির্বিচার? ২ লক্ষ নিরীহ মহিলার সম্ভ্রমহানির বিচার দাবি তার কাছে বিচার না নির্বিচার? যেই তরুণ সমাজ লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যার বিচার দাবি করছে, লক্ষ লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হারানো অমীমাংসিত বিচার দাবি করছে তাকে তিনি বলছেন ‘পাবলিক লিঞ্চিং’!!

তিনি সেই দাবিকে যে শুধু পাবলিক লিঞ্চিং বলেই তার উকালতি শেষ করছেন তা না, লগে রায়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে যারা দেশটাকে আবার পাকিস্তান বানাবার কোশেশ করছেন, দেশটাকে একটা গৃহযুদ্ধের দিকে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন তাদের প্রতিরোধও সমর্থন করছেন না।এইখানে এসে তিনি যেন অস্তিত্ববাদী হয়ে উঠতেছেন। যেন তিনি এড়িয়ে যেতে চাইছেন রাষ্ট্র ও সংবিধানের দোহাই দিয়ে খোদ ইতিহাসকেই।  যেন অবজ্ঞা করছেন একটা রাষ্ট্র অর্জনের পেছনে আত্মত্যাগকেই। সেই রাষ্ট্রের আইনেই তিনি বাঁচানোর জন্য উকালতি শুরু করেছেন সেই রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধীতাকারীদের। হায় ধর্ষক ও খুনীদের উকিল ফরহাদ মজহার।


তিনি নিবন্ধে আরো লিখেছেন ‘এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে অবিলম্বে পুলিশী বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত, বিক্ষোভ  সহিংস হলেও অবিলম্বে তার কারন অনুসন্ধান করা।’ লক্ষ্যণীয় তিনি যে সমস্ত শব্দাবলি ব্যবহার করছেন। সে সবের দ্বারা বাক্যটা কেমন ম্যাজিক সৃষ্টি করতেছে দেখেন।পুলিশের দায়িত্বকে তিনি নিয়ে যাচ্ছেন বর্বরতার কাতারে, হত্যাযজ্ঞের কাতারে। আবার বলছেন বিক্ষোভ সহিংস হলেও যেন পুলিশ চুপ করে থাকে। এর মানে কি খুলে বলতে হবে প্রিয় পাঠক? তিনি জাতিকে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের পথ বাতলাচ্ছেন পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা ও জামাত শিবির হত্যা করলেও, রেল লাইন উপড়ে ফেললেও, অজস্র মন্দির আর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দিলেও কি কারণে করছে তা অনুসন্ধান করা । দেল্যা রাজাকারের ফাঁসির আদেশ পুণ:বিচার করে বেকসুর খালাস করে দেয়া। বোকার স্বর্গে ঠিক কে বাস করে ফরহাদ না এদেশের জনগণ তা জানিনা। কিন্তু ফরহাদ যে চিন্তাপাপি সেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে উঠে।

পুরা লেখাটা পড়ে মনে হতে পারে তিনি যা বলতে চাইতেছেন তার আগাও নাই মাথাও নাই। তিনি কি ভুলে গেছেন বিচ্ছিন্নভাবে সাঈদীদের ফাঁসিকে দেখবার অবকাশ নাই? আজকের যুদ্ধাপরাধী যাদের বিচার করা হচ্ছে বা হবে তাদের বিচার করতে হলে আমাদেরতো ৪০ বছর আগে ফিরতেই হবে। যদি বলি চল্লিশ বছর আগে কি হয়েছে তা নিয়া মাথা ঘামানোর দরকার নাই। তাইলে গত চল্লিশ বছর ধরে যেই নরকের ভেতর বাস করতেছে এই দেশ সেই নরকবাস আরো প্রলম্বিত হবে। যদিও মহাত্মা আহমদ ছফা বলেছিলেন 'আওয়ামীলীগ হারলে সবাইকে নিয়া হারে, জিতলে একাই জিতে'। কিন্তু এইবার আওয়ামীলীগের একা জিতার আর অবকাশ নাই।

ফরহাদ বলছেন ‘মনে রাখতে হবে পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সন্ত্রাসী ভূমিকায় নামলে ধীরে ধীরে তার বিরুদ্ধে পালটা বলপ্রয়োগের পক্ষে জনমত তৈরী হয়।’ গত চল্লিশ বছর ধরে এদেশের পুলিশ যেই বদনাম কুড়িয়েছে তার যেন প্রায়শ্চিত্ত করছে তারা এখন। পুলিশের ভেতর যদিও এখনো অনেক জামাত-বিএনপির রিক্রুট করা নিষ্ক্রিয় পুলিশ রয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান চরিত্র লক্ষণ হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক ও মানবিক অধিকার যে কোন মূল্যে রক্ষা করে।’ খেয়াল করেন তিনি এখানে ইতিহাসের পুরাটাই গাপ করে দিয়ে রাজাকারদের নাগরিক হিসাবে টিকিট দিচ্ছেন। এবং তাদের টেনে নিয়ে আসতেছেন তথাকথিত মানবিকতার কাতারে। এর মানে হচ্ছে ধর্ষিতা ধর্ষককে রক্ষার জন্য সম্ভ্রমের লগে তার অস্তিত্বও বিপন্ন করবে। যে ভুখণ্ড এখনো কোনো রাষ্ট্রেই পরিণত হতে পারে নাই তার কাছে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রবাসনা বাতুলতার শামিল। এই স্ট্রাগলও একটি রাষ্ট্র হয়ে উঠবার স্ট্রাগল ছাড়া অন্য কিছু না।

আগে ভাবতাম ফরহাদ মজহার আওয়ামীলীগ বিরোধীতা করেন। অনেক বাম পণ্ডিতও তা করেন। নিজেও বলি আওয়ামীলীগ বিরোধীতা আর একাত্তরের বিরোধীতা এক জিনিস না। আওয়ামীলীগ যেকোনো কারণেই একাত্তর বান্ধব হলেও একাত্তরের সবটুকু অর্জন এদেশে গণমানুষের। তিরিশ লাখ শহিদের দুইলাখ সম্ভ্রমহারা নারীর। সেই মানুষকেই হত্যা করতে ধর্ষণ করতে সহযোগিতা করেছিল এই রাজাকার বাহিনী যাদের পক্ষে আজ ফরহাদ মজহারের অবস্থান? সেই শহিদ ও সম্ভ্রমহারা নারীদের বিরুদ্ধেই ফরহাদের অবস্থান?

ইতিহাস সাক্ষী এই ঘটনা অনিবার্য ছিল। চল্লিশ বছর অনেক সময়, মীমাংসার ব্যাপারে। এরতো একটা ফয়সালা হবেই। কারণ ধর্ষক আর ধর্ষিতা একঘরে বাস করতে পারেনা, খুনি আর মৃতদেহ একঘরে বাস করতে পারে না। এটা গণহত্যা নয়, মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় সেই অর্থে যুদ্ধই। তিরিশ লাখ শহিদ হয়েছিল সেই যুদ্ধে তখন অনেক অপ্রশিক্ষিত ছিল এইজাতি। তারা এখন অনেক শিক্ষিত যুদ্ধের ব্যাপারে, নিজেদের একটা রাষ্ট্র তৈরির পক্ষে। তিরিশ লাখের প্রতিশোধের ব্যাপারেও।

সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনার ভেতর জামাতশিবিরের যেই নৈরাজ্য কায়েমের চেষ্টা তা তার চেতনান্ধ চোখে যে ধরা পড়বে না সেতো জানা কথাই। সারাদেশে সংখ্যালঘুদের মন্দির ঘরবাড়ি দোকানপাটে আগুন ও ভাঙ্চুর তার চোখে পড়বে না। মুক্তচিন্তার প্রজন্ম প্রতিনিধি রাজিবসহ অন্যান্যদের হত্যাকাণ্ড তার চোখে অপরাধ হতে পারে না কারণ তিনি চেতনান্ধ। এই প্রজন্ম চত্বর এমনই পুলসেরাত সবার চেহারা এখানে আয়নার মতো ষ্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফরহাদ মজহার এদেশের গণমানুষের স্বাধীনতার লগে বেঈমানী করেছেন। লাখ লাখ শহিদের রক্তের লগে বেঈমানী করেছেন। তার অবস্থান  ষ্পষ্ট। তিনি পরিণত হয়েছেন জামাতিদের পেশাদার প্রপাগাণ্ডিস্টে। নিরন্তর এইসব প্রপাগাণ্ডা গেয়ে যাচ্ছেন তিনি নয়া দিগন্ত, আমার দেশ সহ জামাতি টয়লেট্ টিসুগুলাতে। 

ফরহাদ শেষ করেন এই প্রশ্ন রেখে 'এর জন্যই কি এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল? তাহলে কি আপনার ধারণা, এদেশ স্বাধীন হয়েছিল পাকিস্তানের দালাল ঘাতক, গণমানুষের শত্রু। লক্ষ লক্ষ মানুষের খুনিদের গাড়িতে নিরাপদে পতাকা উড়ানোর জন্য? গায়ের জোরে ইতিহাস বিকৃতি আর অবজ্ঞার একটা সীমা আছে।  কে বলেছে আপনাকে এইদেশ স্বাধীন হয়েছে? স্বাধীনতার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি আর জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ও তারপর গণমানুষের থাকার, খাবার, চিকিৎসা ও শিক্ষার অধিকার আদায়ের পর আমরা বলবো এদেশ স্বাধীন হয়েছে।
ফরহাদ মজহার

No comments:

Post a Comment