Thursday, April 11, 2013

হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক ও পরাজিত পাকিস্তানের প্রেতাত্মা


ইসলামে পরধর্মকে আমানত বলা হয়। বিদায় হজের ভাষণেও একটা পয়েন্ট আছে যেখানে বলা হচ্ছে বিধর্মীরা ইসলামি রাষ্ট্রের আমানত। তাদের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব মুসলমানের। হাদিসেও বর্ণিত আছে মুহাম্মদ (সা:) প্রতিদিন খাওয়ার সময় একেকজন অথিতি সঙ্গে নিতেন। একদা তিনি একজন অচেনা পথিককে পেলেন সঙ্গী হিসাবে। খেতে বসে এই অচেনা পথিক বিছমিল্লাহ বলেন নাই। তিনি খানিক রুষ্ট হলেন বটে কিন্তু তা প্রকাশ করলেন না। বুঝলেন এই অথিতি মুসলমান নন। অই সময়ই তার উপর আয়াত নাযিল হয় দুনিয়ায় বিচরিত সমস্ত প্রাণিকুলের রিজিক মহাপ্রভুর হাতে। যিনি খাওয়াচ্ছেন তিনি উপলক্ষমাত্র। কারণ সবসৃষ্টিরই সৃষ্টিকর্তা ও ত্রাণকর্তা আল্লাহ। ইসলামি রাষ্ট্রে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার নিয়া ইসলামি গ্রন্থসমূহে আরো অনেক বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

কিন্তু সবসময় জামাতশিবিরের কাছে প্রথম আক্রমণের বিষয় হিসাবে এইদেশে দেখা গেছে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়। এরও একটা শানেনুযুল আছে। পাকিস্তান আর ভারতের যেই সাম্প্রদায়িক বিভাজন। দেশভাগের পেছনের কারণ নিয়া এখনো অনেক গবেষণা হচ্ছে। সেইসব কারণ ব্যাখ্যা করলে ধর্মভিত্তিক দেশভাগের জন্য সেসময়ের ভারতে হিন্দু বুর্জোয়ারাও কম দায়ি নয়। ভারতের উগ্র হিন্দু আর পাকিস্তান বাংলাদেশের জামাতের মধ্যে খুব একটা ফারাক নাই। যাইহোক পাকিস্তানিরা ভারতিয়দেরকে ’হিন্দু’ বা ভারতিয়রা পাকিস্তানিদেরকে ’মুসলমান’ হিসাবে ট্রিট করে। দেশভাগের ও ছোটখাট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর এই শব্দদুটি আর আগের অর্থ বহন করেনা।

কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্র হিসাবে জন্ম নেয়ার সম্ভাবনার পেছনে অর্থনীতিতো বটেই বাংলাভাষা তথা বাঙালি সাংস্কৃতিক, জাতীয় ঐক্যর বিশাল অবদান ছিল। যেজন্য একই ধর্মানুসারী হওয়া স্বত্তেও পাকিস্তান এক থাকতে পারে নাই। অন্যদিকে একাত্তরে জামাতের ভূমিকা সম্পর্কে এখন সবাই ওয়াকিবহাল। জামাত যেহেতু পাকিস্তানের অন্ধঅনুসারী ও তাবেদার। সেই হিসাবে তারা একাত্তরেই টার্গেট করেছিল হিন্দুদের। রাজাকারদের প্রধান কাজই ছিল হিন্দু নারীদের ধরে পাকিস্তানি আর্মির কাছে নিয়ে আসা। হিন্দুদের ঘরবাড়ি মন্দির জ্বালিয়ে দেয়া। হিন্দুদেরতো বটেই অনেক মুসলমানকেও তারা লুঙ্গি ইত্যাদি খুলে দেখেছে, খৎনা আছে কিনা। শুধু হিন্দুদের নয় যারাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেছে বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী সমাজ। তাদেরকেও খতম করার দায়িত্ব অথবা নিদেন পক্ষে তাদেরকে চিহিৃত করে দেয়ার দায়িত্ব ছিল তাদের।

এই ভুখণ্ডকে কেন্দ্র করে এইটা ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ পাকিস্তানকে দুইভাগ করে ফেলতে পারলে ভারতের সামনে বিভক্ত পাকিস্তান আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেনা। ভারত দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ দ্বারা সরাসরি শাষিত হওয়া ও ভারতের কেরাণি সমাজ যারা শেষের দিকে ব্রিটিশতন্ত্রের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। তারা দীর্ঘ পরিসরে বিষয়টা চিন্তা করতে বাধ্য ছিল। অন্যদিকে ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে এদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অভিভক্ত ভারতিয় সংস্কৃতির বাহক। এদেশের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ফলে আমাদের সংস্কৃতিক মানসও পাকিস্তানের জন্য অস্বস্থির ও অস্থিরতার ব্যাপার ছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যার প্রমাণ।
এদেশের মানুষ ধর্মের খাতিরেও ধর্মীয় ভাষাকে নেয় নাই। অসাম্প্রদায়িকতার এরচে বড় উদাহরণ কী হতে পাওে আর?

অন্যদিকে পাকিস্তানে লুম্পেন সামরিক রাজনীতিকরা মননে ও চালচলনে পশ্চিমমুখি ভোগি হওয়া স্বত্বেও। সাধারণ মানুষের তথা অবুঝের ধর্মটাকেই পুঁজি করে। তারা সরাসরি ধর্মান্ধ মুসলমান সমাজকে কলুষিত করে সাম্প্রদায়িক বিষে। এবং নানা প্রপাগাণ্ডায় তারা এই বিষ ছড়াতে থাকে। যার সাথে ধর্মীয় চেতনার কোনো সম্পর্ক নাই। যেমন এখনো ছড়ানো হয়েছে সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে। যারা ছড়িয়েছে তারা জানে এটা মিথ্যা। কিন্তু তাঁরা ধর্মীয় অন্ধ আবেগকে জাগিয়ে তোলে গণহারে মুসলমানদেরকে বন্ধুকের সামনে বিছিয়ে সাঈদী তথা যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পরিকল্পনা করেছে। অথচ ধর্মের নামে জামাতের মিথ্যাচার যদি কোনো প্রকারে একবার সাধারণ মুসলমান সমাজ ধরতে পারে তাহলে তাদের হাত থেকেই জামাতের রক্ষা পাওয়া দুষ্কর হবে। 

ধর্ম নিয়া এই মিথ্যাচার আজকের নয় এর খানিক ইতিহাস আছে। ১৯৫০ সালে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি রুখতে মার্কিন স্ট্যাট ডিপারর্টমেন্ট এক প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছিল। যেই ডকুমেন্ট সম্প্রতি অনলাইনে ওপেন করে দেয়া হয়েছে। ডকুমেন্টের অনেকগুলা পয়েন্টের মধ্যে একটা পয়েন্ট ছিল যে সমস্ত মৌলানা ওয়াজ মাহফিল করছে তাদেরকে অর্থ ও নানান ধরণের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরো বেশি তৎপর করে তোলা। যেন তারা সবখানে ওয়াজের সময় সুক্ষভাবে কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণা চালাতে পারে। এবং তার ফলও হয়েছে। এখনো গ্রামে গঞ্চের মানুষ ধর্ম বিষয়ে কিছু না বুঝলেও কমিউনিস্ট মানে বুঝে। তাদের কাছে কমিউনিস্ট মানে কাফের, ইসলামের শত্রু। এই সাঈদীরা আরো একধাপ এগিয়ে ছিল তারা প্রচারণা করেছে আওয়ামীলীগ হচ্ছে হিন্দুদের দল, আওয়ামীলীগ ধর্ম মানেনা ইত্যাদি। এইসব ব্যবহার করে দ্রুত তারা জাতিকে দুইভাগে ভাগ করতে সমর্থ হয়।

এখনো বিদেশি মিডিয়া সাঈদীদের ঘাতক, যুদ্ধাপরাধীর বদলে ইসলামী নেতা বলা হয় পশ্চিমি মিডিয়া সেই পুরানা ষড়যন্ত্রই পাকিয়ে তোলে। শুধু মৌলানাদের নয় আজকের যেই ফরহাদ মজহার তাদেরও চিন্তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য এনজিওর মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে অর্থ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্টসহ বিশ্বব্যাংক আইডিবি ইত্যাদি পুঁজিবাদি সংস্থা। এনজিওর জন্মদাতা ছিলেন তৎকালীন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা। তিনি এই পলিসি নিয়েছিলেন ভিয়েতনামে সরাসরি যুদ্ধে মার্কিন পরাজয়ের পর। এটা হচ্ছে তৃতিয় বিশ্বে সাথে পুঁজিবাদের ঠাণ্ডা যুদ্ধ। সরাসরি যুদ্ধে শোষিতদের হারিয়ে দেয়ার চাইতে মননে তাদের আরো পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া।

আজকে যাদেরকে নাইট উপাধি দেয়া হচ্ছে, ম্যাগসেসাই, নভেল দেয়া হচ্ছে সেসব সুশীলদেরও কাজ তাই।এরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। কেউ অর্থনৈতিক ঘাতক, কেউ সাংস্কৃতিক ঘাতক, কেউ সামাজিক ঘাতক। সবার লক্ষ্যই অভিন্ন এদেশে সাধারণ মানুষকে চিন্তায়, অর্থে, সামাজিকতায় সংঘবদ্ধ হতে না দেয়া। এবং বিভ্রান্তি ও সামাজিক নৈরাজ্য জিইয়ে রাখা। সোজা কথা চিন্তায় মানুষকে ঘুম পাড়ানো নাইলে বিভ্রান্ত করা। এক্ষেত্রে ফরহাদ মজহার ও সাঈদীর কাজ মূলত একই। তাই সাঈদীকে রক্ষা করা ফরহাদ মজহারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব।

সাঈদীর ফাঁসির সাথে হিন্দুদের কি সম্পর্ক? আপাত চোখে দেখা না গেলেও অদৃশ্য সম্পর্কতো আছেই। ভারত আর পাকিস্তানের ভেতর যেই সম্পর্ক সাঈদীর ফাঁসির সাথে হিন্দুদের সেই সম্পর্ক জামাতিদের অদৃশ্য মননে। এক্ষেত্রে বলা যায় জামাতিরা যদি সত্যিকার অর্থে মুসলমান হতো তাহলে তারাতো ধর্মমতেই চলতো। অন্য ধর্মের মানুষেরা তাদের কাছে আমানত হিসাবে গণ্য হতো। তাহলে এই শত্রুতা কোথা থেকে আসে। মূলত একাত্তরের পরাজিত শত্রু হিসাবে জামাতে ইসলাম সেই পরাজয় মেনে নিতে পারে নাই। জামাতশিবির মূলত পাকিস্তানের প্রেতাত্মা হিসাবেই বিচরণ করছে এই দেশে। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়া আবার এইদেশকে পাকিস্তান বা বাংলাস্থান বানানোর জন্য তারা বদ্ধপরিকর। জামাত ইসলামের ধোয়া তুলে মূলত সেই পরাজয়ের প্রতিশোধই তারা নিতে চায়।

এক্ষেত্রে এসে গত চল্লিশ বছরে শেখ মুজিবসহ সব শাসককেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়।সাঈদীর ফাঁসির সাথে হিন্দুদের কোনো কারণ না থাকা স্বত্বেও হিন্দুদের মন্দির বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জামাতশিবির যে আক্রমণ করছে এখনো তারা মনে করছে তারা পাকিস্তানি। যাদের জন্মশত্রু ভারতিয় তথা হিন্দুরা। তারা ভাবছে হিন্দুরা ভারতিয় তাদের বাংলাদেশে থাকার অধিকার নাই। তারা এখনো মননে পাকিস্তানকে কত গভীরভাবে লালন করে এটাই তার প্রমাণ। তাই ইসলাম আর জামাতে ইসলাম এক জিনিস নয়। তারা ইসলাম ব্যবহার করে ফায়দা উসুলকারী। তারা মূলত একাত্তরপূর্ব পাকিস্তানের প্রেতাত্মা।

No comments:

Post a Comment