Saturday, April 27, 2013

সাভার ট্রাজেডি: যেখানে ভাষা কাজ করে না



জানিনা কেন যাই। কোথা থেকে আসে এই টান। হয়তো সংবেদনশীলতা থেকে। সংবেদনশীলতা এক ধরনের পাপ। অনুশোচনা। যেন বা নিজের কাছে নিজের কনফেশন। চাকরি বাকরি থাকলে হাসফাস লাগে। অইদিকে মানুষ মরছে আমি এইখানে চাকরি করছি। মনে হয় সাভারে যারা ভবনের দেয়ালে আটকে আছে তাদের মত আমরাও। এরচেয়ে ভাল নাই এদেশের মানুষ। যেদিন ভবন ধ্বসে পড়ে সেদিন সহ্য করি। কাদঁতে থাকে অন্তস্থল। রাতে ঘুমাইতে পারি নাই। বিভিন্নভাবে নিজেরে কল্পনা করি, মনে করি আমার কোমর শুদ্ধ উপরে আটকানো শুধু পাটা ঝুলে আছে নিচে। তখন আমার কেমন লাগবে? চেতনাওকি দুইভাগ হয়ে যাবে তখন? আবার ভাবি। শুধু গলা থেকে মাথাটা আটকানো বাকীটা কোথায় জানিনা তখন কিরকম লাগবে? কোথায় যেন একটা সিনেমা দেখছিলাম নির্মানাধীন একটা ব্রিজের নিচে হেটে যাচ্ছিল কিছু মানুষ হঠাৎ ব্রিজ থেকে লোহার অজস্র রড পড়ে মানুষগুলার উপর প্রায় সবাই গেঁথে যায় সেই রডে। যাইহোক সকালে ঘুম ভাঙ্গে মাথাব্যাথা নিয়ে। ফোন দিই আরেক নিশি পাওয়া মানুষ বাতেন ভাইকে। উনিও ক্ষতস্থান না দেখে শান্তি পান না। সাভার যাওয়ার জন্য তিনিও এক পায়ে খাড়া।

অনেক ঘুরে যেতে হয়। গাবতলীর দিকে গাড়ি ঢুকতে দেয় না। আমরা ভেতর দিয়ে বেড়িবাধে উঠি। আশুলিয়া বাজার থেকে ভেতরের পথ ধরি। আস্তে আস্তে মানুষের যাত্রা শুরু হয়। অজস্র মানুষ, সবাই হাটছে, নীরবে। যেন কোনো অনন্ত শবযাত্রা। শুধু দৃশ্যগুলো খেলা করে। লোহার রড়ে গেঁথে যাওয়া মানুষ, কোমর পর্যন্ত দেখা যাওয়া মানুষ। শুধু মাথাটা আটকে থাকা মানুষ। আরো গভীরে আটকে পড়া অজস্র এখনো বেঁচে থাকা মানুষের আহাজারি পানি.. .. পানি.. ..। 
আদ্র হয়ে আসে দুনিয়ার বাতাস। প্রায় দুইকিলোমিটার আগে থেকে এত মানুষের নীরব মিছিল যে গাড়ি নিয়ে আর আগানো যায় না। কেউ কারো সাথে কথা বলিনা। অবসাদ আর বিষণ্নতা ঘিরে ফেলে আমাদের। গাড়িটা এক জায়গায় রেখে নীরব মানুষের মিছিলে মিশে যাই। জানি সবার ভিতরে একাধিক চলচ্চিত্র। ভিতরে সবাই চলমান। 

সাভার বাজারের দিকে আগাতেই চোখে পড়বে হরেক রকমের পোষ্টার। ’সাভারের মাটি, মুরাদ জংয়ের ঘাটি’। যেন সাভার কোন ব্যক্তির ঔপনিবেশ। চোখে কালো সানগ্লাস দেয়া কোন ভিলেনের মত, কোনটা পাঞ্চাবি গায়ে দেয়া, কোনটা টি শার্ট পড়া। যে কোনো ধরনের পোষ্টারের সাথেই এই মুরাদ জংয়ের ছবি। চোখের জন্য পিড়াদায়ক, রীতিমতো অশ্লীল। তার একক ক্ষমতা বলে যে সাভারের মাটিতে সবই সম্ভব সেটা বোঝা যায় এই কর্মকা- থেকে। যতই ঘটনাস্থলের দিকে আগাতে থাকি ততই ভিড় বাড়তে থাকে। ততই দেখা মেলে অজস্র স্বেচ্ছসেবিদের। কেউ বিনা পয়সায় পথচারীদের পানি খাওয়াচ্ছে। কেউ মানুষকে একপাশে ঠেলে দিচ্ছে যেন অ্যাম্বুলেন্স টানার পথ আটকে না যায়। একটু পর পরই আহত ও নিহতদের নিয়ে ছুটছে মিনি ট্রাক আর অ্যাম্বুলেন্স। আমরা সচকিত হয়ে আরো বেশি সংকুচিত করছি নিজেদের। টেনে নিয়ে আসছি রাস্তার কিনারে। যেন পথটা আটকে না যায়।

আমরা সাংবাদিক ম্যাজিস্ট্রেট বলে ঢুকে পড়ি মুল জায়গায়। যেখানে যেতে দিচ্ছে না মানুষকে। আমার হাতে বাতেন ভাইয়ের ক্যামেরা, বাতেন ভাই বলছেন পারলে ছবি তোলো। আমি বিরক্ত হচ্ছি আমার হাত কাজ করছে না। আমি তাকিয়ে আছি এক নজরে ঘটনাস্থলের দিকে। বুঝতে চেষ্টা করছি, যেখানে দালানটি দাঁড়িয়ে ছিল তার একপাশে মিশে গেছে মাটিতে। অন্যপাশে এখনো একতলা সমপরিমাণ আটকে আছে। একেক ছাদের উপর ভাজ হয়ে আছে বাকি ছাদগুলো। চলছে উদ্ধারকাজ। রাস্তার অন্যপাশে মাইক হাতে সেনাবাহিনী। লোকজনকে সরিয়ে দেবার তোড়জোড় করছে। দাঁড়াতেই দিচ্ছে না লোকজনকে সেখানে। আশপাশের সমস্ত দালান লোকে ভর্তি। কোন কোন দালানের গ্লাসভেঙ্গে দেখছে লোকজন। মনে হচ্ছে ভেতর থেকে অজস্র আহত মানুষ ডাকছে আমাদের যাদের আমরা কোনোদিন দেখি নাই।

আহ পুঁজিবাদের বলি শ্রমিক শ্রেণি। বহুজাতিক কোম্পানি পণ্য তৈরি করতে গিয়ে আর কত মরবে তৃতীয় বিশ্বের জনগণ। পুঁজিবাদ যে কিরকম অবিবেচক ও অমানবিক তার স্মারক হয়ে আছে সাভার ট্রাজেডি। তাদেরকে রীতিমতো হুমকি ধামকি দিয়ে বন্দি করা হয়েছে। ভবনে ফাটল, ভবন পড়ে যেতে পারে এই আশংকায় ছিল সবাই। কিন্তু পুঁজিবাদের কাছে এইগুলা মানুষতো না মেশিন। মেশিনের আবার বাঁচামরা কি যতক্ষণ বেঁচে আছো ততক্ষণ উৎপাদন করো। মুনাফা দাও। কারণ তৃতীয় বিশ্বের শ্রমিকের মতো পশুতো দেখা দেয় নাই আর ইহজগতে। দুইতিন ঘণ্টার টাকায় ১২/১৩ ঘণ্টা শ্রম। প্রতিটি শ্রমিকের প্রায় দশঘণ্টার শ্রম চুরি করে কারখানা মালিক। 

মহাত্মা কার্ল মার্কসের কথা মনে পড়ে যায় ’বুর্জোয়া শ্রেণি যেখানেই প্রাধান্য পেয়েছে, সেখানেই সমস্ত সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক, নির্দোষ সরল সম্পর্ক খতম করে দিয়েছে। যেসব বিচিত্র সামন্ততান্ত্রিক বন্ধনে মানুষ বাঁধা ছিল তার ’স্বাভাবিক উধ্বতনের’ কাছে, তা এরা ছিড়ে ফেলেছে নির্মমভাবে। নগ্ন স্বার্থ ছাড়া, নির্মম নগদ লেনদেন ছাড়া এরা মানুষের সঙ্গে মানুষের আর কোনো সর্ম্পকই স্বীকার করে না। আত্মসর্বস্ব হিসাব-নিকাশের বরফজলে এরা ডুবিয়ে মেরেছে ধর্ম-উন্মাদনার প্রশান্তদিব্য ভাবোচ্ছ্বাস, শৌর্ষমণ্ডিত উৎসাহ ও কুপমণ্ডুক ভাবালুতা। ব্যক্তিমূল্যকে এ রূপান্তিরত করেছে বিনিময়মূল্যে, অগণিত সনদবদ্ধ স্বাধীনতার স্থানে এনে খাড়া করল ঐ একমাত্র, বিবেক বুদ্ধি চালিত নয় এমন, স্বাধীনতা অবাধ বাণিজ্য। এক কথায়, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মোহে অবগুণ্ঠিত শোষণের বদলে এ এনেছে নগ্ন, নির্লজ্জ প্রত্যক্ষ, পাশবিক শোষণ।’ –-কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো।

এই বুর্জোয়া সমাজ একটা চেইনের মতো ধারাবাহিক অর্থনৈতিক বন্ধনে আবদ্ধ। যেমন ক্ষমতাসীন পার্টির এমপি বলে মুরাদ জং ক্ষমতাবান। মুরাদ জংয়ের শিষ্য বলে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা ক্ষমতাবান। সেই ক্ষমতাবলেই চারতলার দালান কোনো রকম অনুমোদন ছাড়াই নয়তলা পর্যন্ত তোলা হয়। এতে কোটি কোটি টাকা আয় হয়। মুনাফার লোভে লোপ পায় মানবতা বিচারবোধ। সেই ভবন বিপজ্জনক জেনেও বহুজাতিক কোম্পানির দেশিয় দোসররা চাকরি খতমের হুমকি দিয়ে হাজার হাজার শ্রমিককে কারখানাবন্দি করে কাজ আদায় করতে থাকে। যতকাজ তত মুনাফা। জীবনের মূল্য কি যদি তা দিয়ে মুনাফা বানানো না যায়। এ ঘটনাতো নতুন নয়, তাজরিনে সেদিন শত শত শ্রমিক জীবন্ত দগ্ধ হলো একটার পর একটা ঘটেই চলেছে শ্রমিক হত্যাকা-। শ্রমিক তারাতো মেশিন, মানুষ না। রাষ্ট্রতো বুর্জোয়াদের পাহারাদার। রাষ্ট্রতো টিকিয়ে রাখে বুর্জোয়ারাই, বিজিএমইয়ের মালিকরাই। রাষ্ট্র কেন শ্রমিকদের স্বার্থ দেখবে?

মহামতি লেলিন বলেন ’ রাষ্ট্র হলো একটি শ্রেণির উপর অন্য একটি শ্রেণির আধিপত্য বজায় রাখার যন্ত্র। .. .. বলপ্রয়োগের একটি স্থায়ী যন্ত্র ছাড়া সমাজের সংখ্যাগরিষ্ট অংশকে অন্য অংশটির জন্য নিয়মিতভাবে খাটতে বাধ্য করা যায় না।.. ..  যদি দাসরাষ্ট্রের কথা বলা হয়, দাসদের মানুষ বলে গণ্য করা হতো না, তাদের যে শুধু নাগরিকের মধ্যে ধরা হতো না তাই নয়, তাদের মানুষের মধ্যেই ধরা হতো না। রোমান আইন অনুসারে তার ছিল অস্থাবর সম্পত্তি। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অন্য সব আইনের কথা তো ছেড়েই দিলাম, নরহত্যার আইনও দাসদের বেলায় খাটতো না।.. ..  দাসের উপর অত্যাচারতো করা যেতই, তাকে খুন করাটাও অপরাধ বলে গণ্য হতো না।-রাষ্ট্র।

এখনোতো তাই আসলে। আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রে শ্রমিক ও মালিকের সম্পর্ক সেই দাসমালিক ও দাসদের চেয়ে উন্নত নয়। এখন চলবে ধনিদের বাঁচানোর ক্ষমতাবানদের বিভিন্ন হাস্যকর ভাঁড়ামি। পৌরযুবলীগের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হিসাবে পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে আছে সাভারের দেয়াল। অথচ প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলছেন সোহেল রানা যুবলীগের কেউ নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লোক হাসাচ্ছেন, বিরোধী দলের উপর দোষ চাপিয়ে দেবার হাস্যকর রাজনীতি করছেন।

ফেরার সময় বাতেন ভাই বলছেন এই যে এত লোক একরাস্তা ধরে আসছে ঘটনা দেখে অন্য রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে নীরবে। এদের মনে কি কোনো প্রশ্ন জাগে না? জাগে না দাসত্বের ভেতর থাকতে থাকতে। এখন দাসত্বই আমাদের ভাল লাগে।

No comments:

Post a Comment