Thursday, April 11, 2013

যুদ্ধাপরাধ বনাম ব্লাসফেমি


ঘটনা মাত্রেরই প্রতিক্রিয়া অনিবার্য। মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বদলে সাধারণ ক্ষমা যেমন আজ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য বিষফোড়ায় পরিণত হয়েছে। তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর প্রগতিশীল পেটি বুর্জোয়া তারুণ্যের জাগরণও জন্ম দিয়েছে অন্য সম্ভাবনার। যেমন কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন মেনে নিতে না পারার কারণে যাবজ্জীবনের বদলে ফাঁসি চেয়ে তরুণদের যাত্রা শুরু। কিন্তু এইরকম এক যুদ্ধাপরাধীর কেন ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন দিয়েছিল তথাকথিত প্রগতিশীল আওয়ামী লীগ সরকার! মূলত একাত্তরের পরে পাকিস্তান মার্কিনি লবি যুদ্ধের মাঠে পরাজিত হলেও যুদ্ধের মানে চক্রান্তের টেবিল ছাড়ে নাই। যেই আন্তর্জাতিক চাপের কারণে মুজিব রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই একই কারণেই কি শেখ হাসিনা সরকার কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন দিয়েছিলেন। 

এর ভেতর থেকে জেগে উঠা অসন্তোষই আজকের গণজাগরণ মঞ্চ। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চ যেই দাবি নিয়া মাঠে নেমেছিল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি। তা সাঈদীর ফাঁসির আদেশের ভেতর দিয়ে বিজয়ে পরিণত হয়। এবং একই সাথে যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদি দল হিসাবে জামাতের টিকে থাকাকেও চ্যালেঞ্চের মুখে ফেলে দেয়। কারণ জামাতের অন্যান্য নেতার সাথে সাঈদীর খানিক পার্থক্য আছে। সাঈদী প্রকাশ্যে জামাতে ইসলামির ব্যানারে আসার আগে এদেশের সাধারণ মুসলিমদের প্রিয় ধর্মীয় ভাষ্যকারে পরিণত হয়। দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ওয়াজ কানে না শুনলেও রেকর্ডে শোনে নাই সেরকম মুসলিম নাই বাংলাদেশে। সাঈদীর জনপ্রিয়তার পুরাটাই ব্যবহার করতে পেরেছিল জামায়াতে ইসলামী।

ফলে সাঈদীর ফাঁসি মেনে নেওয়া আর জামায়াতে ইসলামীর নিষিদ্ধ হয়ে যাবার মধ্যে তেমন কোনো দূরত্ব নাই। তাই জামাত যে মরিয়া হয়ে উঠবে সেই বিষয়ে যদি আওয়ামী বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ গণ আগাম ধারণা করতে না পারেন তাহলে তাদের দূরদর্শীতা নিয়ে সন্দেহ করবার যতেষ্ট অবকাশ থেকে যায়। শুধু তাই নয় যুদ্ধাপরাধের বিচার যে পক্ষান্তরে জামাত ধ্বংসেরই নামান্তর সেটাতো দিবালোকের মত সত্য। কারণ রাজাকারদের অধিকাংশই রাজনৈতিকভাবে জামায়াতে ইসলামীতে পুনর্বাসিত। শুধু তাই নয় রাজনীতি সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন জামায়াতে ইসলামী দেশটাকে আবার পাকিস্তান তথা বাংলাস্থান বানানোর সব ধরনের পরিকল্পনা নিয়েই আগাচ্ছে। তাদের রয়েছে যতেষ্ট আর্থিক উৎস। গোটা দুনিয়া জুড়ে গড়ে উঠছে তাদের নেটওয়ার্ক। তাদের এই আর্থিক উৎস যেমন জামায়াতে ইসলামীর নির্ভেজাল কর্মী দিয়ে পরিচালিত হয় তেমনি এর আর্থিক লাভবানও হয় জামাতের কর্মীগণ। ফলে জামায়াতে কর্মীদের বেঁচে থাকার কাজ আর আদর্শের কাজ আসলে একই। ‘জামায়াতে ইসলামী’ দলটি আজ জামাতশিবিরের বেঁচে থাকার ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাসের উৎস।

এত স্বল্পসময়ে জামাতের এত প্রসারের পেছনে খানিক পুঁজিতান্ত্রিক ইন্ধন আছে। কার্লমার্কস যে কারণে ধর্মকে আফিম বলেছিলেন। অর্থাৎ যন্ত্রণা রোধক। বুর্জোয়াদের শোষকযন্ত্রের যন্ত্রণার ভেতর ধর্ম যেন খানিকটা তাদের ব্যাথা রোধ করে। কারণ ধর্ম বলে তাদের এই যে যন্ত্রণা এটা তাদের পাপের ফল অথবা ইশ্বর মোমিনদেরকে পরীক্ষা করছেন। কারণ এই দুনিয়া কষ্টের, এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আর তাই এই যন্ত্রণা  তাদের নিয়ে যাবে মৃত্যুর পর আসল দুনিয়ায়। অর্থাৎ বেহেস্তে। ফলে সাধারণ শোষিত মানুষ এই কষ্টের দুনিয়া ছেড়ে যাবার জন্য আকুল হয়ে থাকে। তার উপর যদি সেটা হয় ধর্মের শত্রুদের খতম করার মত কাজ তাহলেতো বেহেস্ত অনিবার্য। কারণ বাংলাদেশের আওয়ামী বা জাতীয়তাবাদি বুর্জোয়াদের  শোষণের হাত থেকে বাঁচার তাদের সামনে আর কোনো পথ আপাতত খোলা নাই। 

তবে এইসব সাধারণ মুসলিমদের এইরকম অশিক্ষিত করে রাখার জন্য বুর্জোয়াদের শিক্ষাব্যবস্থাই দায়ি। দেশের ভাল ভাল স্কুল কলেজে বিদেশের স্কুল কলেজে ভাল ভাল শিক্ষা এই সব বুর্জোয়াদের ছেলেপিলেরাই পায়। আর গরীবদেরকে প্রগতিহীন চেতনাহীন সুবিধাবঞ্চিত রাখার জন্য রয়েছে মসজিদ, মাদ্রাসা আর  মান্ধাত্বার আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা। যেখানে পড়ে চলমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোনো কাজে তারা আসতে পারে না। খুব দ্রুত এই সব গরীর মুসলমান তথাকথিত প্রগতিশীল বুর্জোয়াদের বিপক্ষে যে নিজেদের দাঁড় করাবে তাতে আর সন্দেহ কি? বুর্জোয়ারা যেই ভোগের জীবন যাপন করে তাকে যে তারা ঘৃণা করবে, বুর্জোয়াদের ভোগের সংস্কৃতিকে যে তারা বেদাত বলবে তাতে সন্দেহ নাই। ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ এমনি এমনি হয় না। একটা জনগোষ্ঠীকে এটার ভেতর রেখে দেওয়া হয়। এবং সেই বঞ্চনা থেকেই জন্ম নিতে থাকে ঘৃণা। 

ফলে সে সব প্রগতিশীল স্কুলে বুর্জোয়া পেটিবুর্জোয়ারা লেখাপড়া করে আজ ধর্মের সমালোচনাসহ গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারের কথা বলা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবি আন্দোলনের মাধ্যমে, ঠিক একই জায়গার অপর পিঠ থেকেই আসছে ব্লাসফেমি আইনের দাবি। কারণ যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে গেলে জামাত নিষিদ্ধ করতে হবে। জামাত নিষিদ্ধ মানে এদেশে গরীব মুসলমানদের ধর্মভিত্তিক সংগঠন নিষিদ্ধকরণ। তো সেটাকে সাধারণ মুসলমান তাদের সর্বশেষ আশ্রয় হারিয়ে ফেলাই মনে করছে। মানে আমাদের শোষণবঞ্চনা ছাড়াতো আর কিছু নাই এখন ধর্মটাও যদি হারিয়ে যায় তাহলে আমাদের আর কি থাকলো। এখন জামাত আদৌ ধর্মভিত্তিক সংগঠন কিনা নাকি তারা ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে তৎপর সেইটা ভিন্ন বিষয়।

এখন জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিকভাবে সরাসরি প্রতিহত হবার কারণে তারা যে হাজার রকম পলিসি নিয়ে আগাবে সেটা রাজনীতি সচেতন মানুষ মাত্রেই জানে। হেফাজতে ইসলামীর ভেতর মিশে যেতে জামাতের পলিসিগত কারণে সময় লাগার কথা না। কারণ হিসাবে বলা যায় যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবির ভেতর দিয়ে যখন জামাত নিষিদ্ধের বিষয় আলোচিত হচ্ছে ঠিক সেই সময় হেফাজতে ইসলামের উত্থান। তারা এতদিন কোথায় ছিলেন? একাত্তরের লাখলাখ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা লাখ লাখ নারীদের ধর্ষণ বিষয়ে তাদের কোনো কথা নাই। কোরানে হাদিসে কোথায় লেখা আছে তা? একাত্তরের নিহতদের মধ্যে, ধর্ষিতদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান সেই নিহত মুসলমানদের হত্যার দাবিতো কোনোদিন হেফাজতে ইসলামী করে নাই। যখন সেই বিচার চাইছে পেটিবুর্জোয়া তরুণ সমাজ তখন কেন তাদের ইসলামের প্রতি এত দরদ উৎলে উঠল?

যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইছে সেই সব তরুণদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে তারা নাস্তিক। কারণ নাস্তিকতা শব্দটি এদেশের সাধারণ মুসলমানের মর্মমূলে গিয়ে আঘাত করে। কারণ তাদের ধর্ম ছাড়া আর কিছু নাই। সেই যন্ত্রণারোধক ধর্মকেই যারা স্বীকার করে না তাদের বিষয়ে কোনো আপোষ করবে না সাধারণ মুসলাম। সেই সুযোগই গ্রহণ করছে জামায়াতে ইসলামী। এরজন্য দরকার হলে তরুণদের নামে ব্লগ খুলে নিজেরাই এমন পোষ্ট দেবে যাতে মানুষকে আরো উত্তেজিত করা যায়। এটাও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটা রাজনৈতিক কৌশল। যখন তরুণরা রাজাকারদের ফাঁসি চাইছে। তখন হেফাজতে ইসলাম নাস্তিক অপরাধে সেই তরুণদেরই ফাঁসি চাইছে। যখন তরুণরা জামাত নিষিদ্ধের আইন চাইছে তখন হেফাজত ব্লাসফেমি আইন চাইছে। এসব লক্ষণ দেখে সহজেই অনুমান করা যায় হেফাজতে ইসলামের পেছনে কাদের ইন্ধন আছে।

অন্যদিকে শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাওয়া জনবিচ্ছিন্ন পেটিবুর্জোয়া তরুণরা যাদের আন্দোলনে জনভিত্তিক কোনো এজেন্ডা নাই। এই মঞ্চে আওয়ামী লীগ মন্ত্রীরা এসে একাত্ততা প্রকাশ করে গেছে। এটার পেছনে যে আওয়ামী লীগ কলকাঠি নেড়েছে তা ষ্পষ্ট। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে এই মঞ্চ রক্ষা করবে না তাতো ব্লগারদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হওয়া শুরু করেছে। কারণ নাস্তিকতা এমন এক অপপ্রচার যা রাজাকার প্রসঙ্গকে ঢেকে দিতে পারে। খোদ মুসলিম আওয়ামী লীগারদের ভেতরও একজন মুসলমান বাস করে। তারাও মেনে নেবে না। নাস্তিক নামে যাদের গ্রেপ্তার করা হবে আওয়ামী লীগাররাও কিছুদিন পর তাদের বিচার চাইবে। কারণ আওয়ামী লীগ বিএনপি হচ্ছে ব্যবসায়ী দল। তাদের অধিকাংশ ভোক্তা যদি সাধারণ মুসলমান হয় তাহলে তাদেরকে তারা আঘাততো করবেই না বরং তাদের দাবিকেই নিজেদের দাবিতে পরিণত করলেই তাদের ভোটব্যাংক ভরে উঠবে।


 

No comments:

Post a Comment