Wednesday, May 29, 2013

ব্যাংক ও কর্পোরেট দুনিয়ার সাহিত্য পুরস্কার

বাংলাদেশে সম্প্রতি বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক ও কর্পোরেট হাউজগুলোর আলাদা বা যৌথভাবে সাহিত্যের নামে পুরস্কার দেয়ার হিড়িক পড়েছে। এত ডাকঢোল বাজিয়ে এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কেন সাহিত্যের নামে পুরস্কার দিচ্ছে ব্যাপারটা ভেবে দেখবার মতো। প্রথমে ব্যংকের কথাই ভাবি, ব্যাংকের কাজ সম্পর্কে মোটামুটি সবাই জ্ঞাত। এটা এমন এক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যার সবই সুদের ফটকা ব্যবসা। ব্যাংক সঞ্চয়মুখি জনগণের কাছ থেকে সাধারণ সঞ্চয়সহ বিভিন্ন স্কিমে জামানত হিসাবে টাকা সংগ্রহ করে আর চালু ব্যবসায়ীদের সেই টাকা ঋণ দেয়। যাদের কাছ থেকে ব্যাংক নিজে জামানত নেয় তাদের সুদ দেয় কম, আবার যাদেরকে তারা সেই টাকা ঋণ দেয় তাদের কাছ থেকে চড়া সুদ নেয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে চালু ব্যবসা কী? মোটা দাগে গার্মেন্টস সেক্টর, ওষুধ সেক্টর, প্লট বা ফ্ল্যাট ব্যবসা, খাদ্য ব্যবসা ইত্যাদি। ক্ষুদ্র অনেক ব্যবসা থাকলেও বৃহৎ পুঁজি খাটে উল্লেখিত ব্যবসায়। আবার এই ব্যাংকও বহুজাতিক ব্যবসা চক্রের অংশ। একেকটা বহুজাতিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে এখন সব ধরনের ব্যবসায় বিনিয়োগ থাকে। এরা এমন ব্যবসাচক্রের প্রসার করছে একই কোম্পানির বস্ত্রব্যবসা, ওষুধ ব্যবসা, খাদ্য ব্যবসা, শিক্ষা ব্যবসা, রিয়েল এস্টেট ব্যবসা, চিকিৎসা ব্যবসা, মিডিয়া ব্যবসা, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের ব্যবসা থেকে শুরু করে সব ধরনের ব্যবসা করে থাকে। এরকমও হতে পারে যে এক কোম্পানির টিভি বা পত্রিকায় চমৎকার বিজ্ঞাপন দেখে ভাল প্যাকেটে খারাপ খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হয়ে গেলেন, ভর্তি হলেন এই একই কোম্পানির হাসপাতালে, চমৎকার সাজসজ্জার হাসপাতালে গলাকাটা দামে চিকিৎসা করলেন, খেলেন এই একই কোম্পানির নিম্নমানের ওষুধ; তাও চড়াদামে। চিকিৎসার অবহেলায় আপনার মৃত্যু হলে মিডিয়া তা চেপে যাবে, কারণ মিডিয়াও এই একই কোম্পানির। মোটকথা আপনি এসব বহুজাতিক কোম্পানির দখলে। এই বহুজাতিক কোম্পানি টিকিয়ে রাখতে গেলে তার একটা রাজনৈতিক রূপরেখা দরকার। ফলে রাজনীতিটাও, পক্ষান্তরে ক্ষমতাটাও এদের হাতে।

এখন বিচ্ছিন্ন করে এই ব্যবসাগুলো দেখা যাক। গার্মেন্টের ব্যবসা সম্পর্কে এদেশের সচেতন মানুষ খোঁজখবর রাখেন। রানাপ্লাজা, তাজরিন, স্পেকট্রাম, স্মার্টের ঘটনার পর গার্মেন্টসের অনেক খবরাখবর জনগণ পাচ্ছেন। এটা সম্পূর্ণ লুটপাটের জায়গা, শ্রমিকদের রক্তে অমানবিক এক পুঁজিবানানোর হাবিয়া দোযখ। লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করে এই সেক্টরে। মাসে তিন হাজার টাকা বেতন দিয়ে যাদেরকে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকার পরিশ্রম করিয়ে নেয়া হয়। বাকী ১২ হাজার টাকাই মালিকের লাভ। দিনের পর দিন এই একই শোষণ প্রক্রিয়া, অমানবিক দাসত্বের পরিবেশে তাদের বেঁচে থাকার সমস্ত সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়ে গুটিকয় মানুষের পুঁজি তৈরির কারখানা এসব। এই খাতে ব্যাংকগুলার রয়েছে বিশাল বিনিয়োগ, হয়ত বাংলাদেশে সবচাইতে বেশি ঋণ দেয়া হয় এই সেক্টরে।

চিকিৎসা সেবা মানুষের নৈতিক অধিকার হলেও, ওষুধপথ্য বিনা পয়সায় পাওয়ার কথা থাকলেও বর্তমানে বাংলাদেশে সবচাইতে জল্লাদ ব্যবসা হচ্ছে চিকিৎসাব্যবসা। চিকিৎসা করাতে গিয়ে আর অষুধ খেতে গিয়ে জীবনের সমস্ত সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে অনেক মানুষের। এই যে অষুধ বানানোর শ্রমিক, তা বিক্রির শ্রমিক- তাদেরকেও অবিকল একই কায়দায় তাদের শ্রম থেকে বঞ্চিত করা হয়। ঠিক এভাবেই বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষা ইত্যাদি মৌলিক অধিকার এখন এদেশে সবচাইতে লাভজনক ব্যবসা।

এই প্রত্যেক ব্যবসার টার্গেট বা ভোক্তা হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষকে অতিদামে নিম্নমানের চিকিৎসা দিয়ে, সাধারণ মানুষের রক্ত ও ঘাম থেকে শ্রম ঘণ্টা মেরে দিয়ে, সাধারণ মানুষকে পুষ্টি কম দিয়ে অর্থাৎ তাকে দুনিয়ায় তার সাংবিধানিক অধিকারকে তার কাছে বিক্রি করে তার ভেতর থেকে গুটিকয় মানুষকে মুনাফা তথা পুঁজিপতি বানানো এবং তার ঋণের চড়া সুদে নিজের দেহ আরো প্রসারিত ও নিজের ফাটকা ব্যবসার আরো বিস্তার ব্যাংকের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। সেই লাভেরই এক ক্ষুদ্র অংশ সে ব্যবহার করে তার বিরুদ্ধে যেন কোনো জনমত গড়ে না উঠে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলাতো তাদের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন করে তাদের নিজস্ব পত্রিকা ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া দিয়ে। তাই সামাজিক সুনাম যে সমস্ত বিষয়ের সাথে জড়িত সেখানে সে সামান্য বিনিয়োগ করে তার সুনাম বাড়িয়ে তোলার জন্য। তথাকথিত এই সাহিত্য পুরস্কার এরই অংশ।

আর অন্যদিকে সাহিত্যের কাজ প্রায় সম্পূর্ণই এর বিরোধী। সাহিত্যকে বলা হয় হিতের চেতনা। সাহিত্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা অনেকাংশে একটা জাতির চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করার মতোই। ব্যাংক বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলার যদি বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে এতই দায়িত্ববোধ থাকত, তাহলে তারা প্রকাশকদের আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রচুর ঋণ দিতে পারত। বইয়ের গুণগত মান বাড়িয়ে, লেখককে তাদের রয়ালিটি নিশ্চিত করে, বই উৎপাদন ও তা বিক্রয়ের জন্য গোটা দেশে একটা চমৎকার নেটওয়ার্ক তৈরি করে গণচেতনার সৃষ্টি করতে পারত। বাংলাদেশে ষোল কোটি এবং কলকাতায় মিলিয়ে গোটা দুনিয়া প্রায় আরো দশ কোটি বাঙালি বাংলাভাষায় কথা বলে, পড়ালেখা করে। ১০ থেকে ১২ কোটি ভাষাভাষি ফ্রান্স, রুশ, ইত্যাদি ভাষার সাহিত্যবাজারটা অনেক বড়। ২৬ কোটি বাংলাভাষিদের মধ্যে এক কলকাতার সাহিত্যবাজার ছাড়া বাংলাদেশের বাংলাসাহিত্য বাজার নাই বললেই চলে। তার উপর ঢাকাসহ দেশের বিভাগীয় শহরের বড় বইয়ের দোকানগুলা কলকাতার বইয়ের দোকান। আর মফস্বলে মকছুদুল মোমেনিন বা হাশরের পরে জাতীয় বই ছাড়া ভাল মানের কোনো সাহিত্য পাওয়া যায় না বললেই চলে। ভেতরে এরকম নানা জটিলতা রেখে কয়েকজনকে সাহিত্যের নামে এত বাজনা বাজিয়ে পুরস্কার দেয়াটা অনেকটা পোকায় খাওয়া গর্ত ঢাকা দেয়ার জন্য কার্পেট বিছানোর মতই।

অথচ ব্যাংক ও বহুজাতিক বেনিয়ারা যা করে তা হচ্ছে গুটিকয় ব্যাংক মালিকদের বা লিয়াজোকারীদের আত্মীয়স্বজনকে লেখক নাম দিয়ে পুরস্কার দিয়ে সাহিত্য জগতে একটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছে। সাহিত্যের মানে তাদের কিছু আসে যায় না। দেখা যাবে যে কজনকেপুরস্কার দেয়া হয় অল্প টাকা। তার অনেকগুণ বেশি খরচ করা হবে প্রচারণায়, বিজ্ঞাপনে, বিলবোর্ডে, অতিথি আপ্যায়ণে, অডিটোরিয়ামের সাজসজ্জায়। উপস্থিত করবে ক্ষমতাধর কোনো মন্ত্রী; যার আবার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। পুরস্কার প্রদানের পর আবার বিজ্ঞাপণ, আবার প্রচারণা। মূলত এই প্রচারণাই তাদের লাভ।

একাধিকবার এইভাবে লাগাতার পুরস্কার প্রদানের প্রভাব জনমনে স্থায়ী হয়। এটা সংস্কৃতিরই অংশ হয়ে উঠে। যেহেতু সাহিত্য পঠনপাঠনেরই বিষয়। সাহিত্যর কথা উঠলেই সাথে ভেসে উঠবে সেই সব ব্যাংকের নাম, বহুজাতিক কোম্পানিগুলার নাম, যা সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করেছে। তখন সমাজ ব্যাংককে বা বহুজাতিক কোম্পানির সব শোষণ ভুলে সেসবকে হিতকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে গণ্য করবে। না হলে সাহিত্যের মতো একটা অলাভজনক কিন্তু প্রচারবহুল জায়গায় ব্যাংক বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলার কী কাজ?

প্রশ্ন উঠতে পারে কাদেরকে দেয়া হবে সে সব পুরস্কার? ব্যাংকের টার্গেট থাকবে কোনো সিরিয়াস লেখককে সেই পুরস্কার দিতে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে একজন লেখক এই পুরস্কার গ্রহণের আগে যেহেতু পুরস্কার দাতার স্বভাব ও উদ্দেশ্যের নেতি নিয়ে প্রশ্ন করবে। এবং অবশ্যই এসব প্রতিষ্ঠান তাদের এই পুরস্কার নিয়ে বিতর্ক তৈরি করবে না। তাই পুরস্কার দেয়ার আগে তারা সেই লেখকের সাথে কথা বলবে। এই সমস্যা এড়ানোর জন্য ব্যাংক খোঁজে বার করবে সাহিত্যিক ব্যবসায়ীদের; যারা অনেক আগেই নিজেদের আত্মা বিক্রি করে দিয়ে হাজির হয়েছে এখানে। আর রুজ লাগিয়ে অপেক্ষা করছে সড়কে পরবর্তী খদ্দেরের আশায়। এদের বাস সাহিত্যের কানাগলিতে, এরা সবখানেই আছে, এরা বহুরূপী। ব্যাংকের যেহেতু লেখার গুরুত্ব নিয়ে কাজ নাই সেহেতু সাহিত্যের নামে যে কোনো কিছুকেই তারা পুরস্কার দিতে পারে। এরা এই আত্মাবিকৃত জীবগুলি যারা ঘোরাফেরা করবে নিয়ত ব্যাংকের এজেন্টদের আশপাশ; এবং এরাই এইসব পুরস্ককারের যোগ্য। সত্যিকার অর্থে দেখা যায় এ পর্যন্ত কোনো ভাল লেখককে ব্যাংক পুরস্কৃত করতে পারে নাই, পারবেও না। কারণ সাহিত্য কোনো কিছুর বিনিময়ের জন্য তৈরি হয় না। এটা দায়বোধের ব্যাপার। এই পুরস্কার নেয়ার মাধ্যমে অনেক ভাল লেখকও নিজের আত্মা বিক্রয়ের সুযোগ পায়। বিনিময়ে তাকে পণ্য করে তাঁরা, তাকে দেয়া অর্থমূল্যের বহুগুণ সুনাম বাজার থেকে তুলে নেয় ব্যাংক বা বহুজাতিক কোম্পানিগুলা। আমাদের জীবদ্দশাতেই এরকম বহু লেখককে তাদের যুদ্ধাংদেহি পোশাক খুলে নাচের পোশাক পরতে দেখেছি আমরা।

তবু এখানেও ব্যাংক বা কোম্পানিগুলা ভাড়ামো করবে, তারা বই আহ্বান করবে, আহ লুম্পেনরা দলে দলে প্রতারিত হতে যাবে সেখানে। তার বুঝতেও অক্ষম এই পুরস্কার অনেক আগেই দেয়া হয়ে গেছে তাদের বাছাই করা দালালদের। যতই আনুষ্ঠানিকতা ততই প্রচার এটাই তাদের লাভ। এমনিতেই গত চল্লিশ বছরে দায়বোধের জায়গায় এদেশের সাহিত্য প্রায় শূন্যের কোটায়; যা এখনো এদেশে সাহিত্য বলে আমরা পড়ছি তা চল্লিশ বছর মানে ৭১’র আগে জন্ম নেয়া। এরপরের সাহিত্যকে বলা যায় হাইব্রিড সাহিত্য। ফেনানো, যার মধ্যে আবহমান বাংলার সাধারণ মানুষের সংগ্রামের কোনো ধারাবাহিকতা নাই। বাংলাদেশের অন্যান্য সেক্টরের মতই এখানেও সচেতনভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে সিন্ডিকেট। এখানেও গড়ে উঠেছে চিছকে মাস্তানদের দৌরাত্ম্য। বহুজাতিক কোম্পানিগুলা তাদের বাধাধরা দালাল কবিদের দিয়ে কবিতা সংকলন, গল্প সংকলন ইত্যাদিও করাচ্ছে। তাতে ঢোকানো হচ্ছে বাছা বাছা দালাল কবি, সাহিত্যিক নামের প্রাণিদের। যাদের লেখার সাথে সাহিত্যের কোনো সংযোগ নাই।

No comments:

Post a Comment