Sunday, June 16, 2013

সাম্রাজ্যের মন, স্পিলবার্গের প্রাচ্য অথবা ইন্ডিয়ানা জোন্সের বিচার



দুনিয়ার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পাঁচজন কালজয়ী চলচ্চিত্রকারের নাম চেয়ে একবার দর্শকদের কাছে  ভোট আহ্বান করেছিল মার্কিনমুলুকের অন্যতম বাজারি পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস। পাঠকদের পাঠানো প্রতিক্রিয়া বা ভোটের ভিত্তিতে স্টিভেন স্পিলবার্গের নাম ভেসে উঠে পয়লা নম্বরে। একজন পরিচালক হিসাবে চলচ্চিত্রের টেকনিক, ম্যাকানিজম ও টেকনোলজির ব্যবহারে তিনি অপূর্ব। তার তৈরী সিনেমার মধ্যে ‘ইন্ডিয়ানা জোন্সের চারটি সিক্যুয়াল [Raiders of the Lost ArkIndiana Jones and the Temple of DoomIndiana Jones and the Last CrusadeKingdom of the Crystal Skull]  ও জুরাসিক পার্কের সিক্যুয়ালসমূহ [Jurassic Park, The Lost World, Jurassic Park III, Jurassic Park 4 The Extinction]দেখেন নাই এরকম দর্শক পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।

সিনেমার নিজস্ব ভাষা বা ক্যামেরা মুভমেন্টের ব্যবহারে তিনি এত দক্ষ যে, তার সিনেমা ইংরাজি ভাষা না জানলেও কারো ভাষাগত সমস্যা হয় না। শিশুর লাহান ইশারাভাষী দর্শকও তার ছবির দিকে বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকবে। একজন পরিচালক হিসাবে এটাই তার সফলতার মুল কারণ। তার সিনেমাগুলা একে একে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জনপ্রিয় ছবিতে জায়গা করে নিয়েছে ইতোমধ্যে পশ্চিমা মিডিয়াগুলার বাজারি পরিসংখ্যানে।

এক জবানদান অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন ‘আমি চলচ্চিত্রের ভাষায় ছবি বানাই’।
কথাটা হাস্যকর শোনালেও আলবৎ হাছা। যে পরিচালক চলচ্চিত্রের ভাষায় ছবি বানায় তার ছবিতে ভাষাগত সমস্যা হয় না। যেমন ডব্লিউ ডি  গ্রিফিথ, আইজেনস্টাইন, চ্যাপলিন, ডে সিকা, জা লুক গদার, ইলমাজ গুণে, ফাসবিন্ডার, পুদোভকিন, দভজেঙ্কো, হিচককদের ছবি দেখতে ভাষার সমস্যা হয়না  কোনো দর্শকের। এদের মধ্যেও সবশ্রেণির দর্শকদের কাছে স্পিলবার্গের গ্রহণযোগ্যতা বিষ্ময়কর। কারণ তার বিষয়-বৈচিত্র। সব ধরনের বিষয় নিয়াই তিনি কাজ করেছেন। জনপ্রিয় ধারার জিকজাক ছবি করার জন্য সিরিয়াস সমালোচকরা তাকে ‘মুভি জাগলার’ বা ‘মুভি ম্যাগনেট’ বলে গাল পাড়েন।  জনপ্রিয় ধারার ছবি যেমন তিনি তৈরি করেন তেমনি বর্ণবাদ নিয়ে তৈরি করেন ওয়াকার এলিসের ফিকশন অবলম্বনে ‘কালার পার্পল’র মত সিরিয়াস ধর্মী ছবি বা নাজিযুগ নিয়া বানান ‘শিল্ডলার্সলিস্ট, মিউনিখ’। 
তার প্রত্যেকটা ছবিতেই প্রায় সর্বোচ্চ ব্যবসা ও অ্যাকাডেমি পুরষ্কার ধরাবাঁধা। 

তার প্রথম যে সিনেমাটা ছোটবেলায় নিজের অজান্তে একঘণ্টা তিরিশ মিনিট আমাকে টেলিভিশনের পর্দায় আটকে  রেখেছিল তার নাম ‘জস’।
ছবি যে এত আকর্ষক ও আনন্দদায়ক হতে পারে এই প্রথম জানা। ‘জস’র পরের সিক্যুয়ালতো বটেই, স্পিলবার্গজির এমন কোনো ছবি নাই যা সংগ্রহ করি নাই বা দেখি নাই। শুধু একবার নয় বহু বহুবার করে একেকটা ছবি দেখা। দেখি কারণ তার সিনেমার শব্দ ব্যবহার, ডিটেলসের ব্যবহার, ক্যামেরা মুভমেন্ট, কালচেতনা, ইনার আই ও গতি অসামান্য।
সম্প্রতি আবার তার ‘ইন্ডিয়ানা জোন্স’র সিক্যুয়ালগুলো  দেখতে গিয়া চোখ আটকে গেল। বিশেষ করে ‘রেইডার্স অব দি লস্ট আর্ক,‘টেম্পল অব ধূম’ ছবি দুইটা দেখে মনে হল এগুলা নির্মাণগত মুগ্ধতা স্বত্বেও পূণবিবেচনা দাবি করে। 
রেইডার্স অব দি লস্ট আর্ক ছবিটা দেখার আগেই  বইটি পড়া ছিল। ক্যাম্পবেল ব্ল্যাকের দুর্দান্ত ত্রিলার। অনেকদিন আগে পড়া, কোন দোষ খোঁজে পাই নাই তখন। মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়েছি। পরে এই ছবির কোথাও লেখকের নাম না দেখে একটু বিষ্মিতও হয়েছি। হয়তো আমার চোখে পড়ে নাই এরকমও হতে পারে। 
বলাবাহুল্য স্পিলবার্গ খুব বাধ্য আমেরিকান। আমেরিকান বা হলিউডের আদর্শই তার আদর্শ। এবং আমেরিকার দেবত্ব ও হিংস্রতা, প্রাচ্যদখলনীতি, ঘৃণা, তুচ্ছতা ও আতঙ্কের চোখে প্রাচ্যকে দেখা ইত্যাদি গুণ তার মধ্যে পুরাপুরি জারি আছে। যার প্রমাণ লুকিয়ে আছে তার এই সিনেমায়।
রেইডার্স অব দি লস্ট আর্কে আমরা দেখতে পাই  নেপাল আর মিশরকে। ইন্ডিয়ানা জোন্স নেপালে বেশিক্ষণ থাকেন নাই। খুব স্বল্প সময়ের যে নেপালকে দেখানো হলো তা হচ্ছে রেস্তোরায়, বারের ভেতর ঝগড়ারত মামুলি জনগণ, গুপ্তধনের জন্য হত্যামুখি চায়নিজ-নেপালি যে কিনা লোভ করতে গিয়ে প্রায় আগুনেই পুড়তে বসেছিল তার পাপের প্রায়শ্চিত্য হিসাবে। প্রাচ্যবাসীর হাতে ভয়ংকর অস্ত্র  থাকা সত্বেও মাত্র একটা চাকুক নিয়ে ইন্ডি বধ করে ডজন দুয়েক চায়নিজ-নেপালিকে। 

তবে ছবির অর্ধেক জুড়ে মিশরকে দেখা যায়। আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের আরব বা প্রাচ্য বিরোধিতার পুরাপুরি প্রমাণ পাওয়া যায় ছবির এই মিশর খণ্ডে। তিনি মিশরি আরবদের উপস্থিত করেন ভয়াবহভাবে। তারা লম্বা দাঁড়ি রাখে কারণ জাতে মুসলমান। ভয়ংকর জোব্বা পরে। জাত অপরাধী আর বগলে ছুরি নিয়ে ঘুরে। খাবারে বিষ মেশায়। বিদেশি নারী দেখলেই ধর্ষণ করতে চায়। বানরের মত একটা নীরিহ প্রাণিকে স্পাই হিসাবে ব্যবহার করে কাজ হাসিল করে। মিশরিরা খুব খারাপ তারা ক্রীতদাসদের নিয়ে মাটি খনন করায়। ক্রীতদাসদের বেত্রাঘাত করে। যেন আমেরিকানরা কোনদিন ক্রীতদাস দেখে নাই। ছবিটি  দেখতে দেখতে স্পিলবার্গের দুর্ধর্ষ ক্যামেরায় এই সব দৃশ্যগুলো ফ্রেমিং হবে আর দর্শকদের চোখ আটকে থাকবে তাতে। এসব দৃশ্য দেখতে দেখতে মনে হয়  আহা ক্যামেরাটা মিশর থেকে সরে গেলেই বাঁচি, এত খারাপ মিশরিয় জনগণ। তার সাথে সাথেই প্রায় স্পিলবার্গের অবচেতনেই হয়তো উঠে আসতে থাকে আমেরিকানদের আগ্রাসী চেহারা। এতগুলো দুবৃত্ত, এত ষড়যন্ত্র ইন্ডি একাই প্রতিহত করে বীরত্বের সাথে। যেন সে কোন অবতার। এই কালো স্বাস্থ্যহীন মানুষগুলার ভেতর। কালো মানুষগুলোর হাতে আছে ছুরি আর তলোয়ার। একসঙ্গে অনেকেই ইন্ডিকে আক্রমণ করে কিন্তু হঠাৎ ইন্ডি বন্দুক বার করে এক গুলিতেই সব নিকেষ করে।

‘টেম্পল অব দি ধুম’ পর্বে  দেখানো হয় চায়না আর ভারতকে। এ পর্বে আরও ভয়াবহভাবে উপস্থাপন করা হয় প্রাচ্যবাসীকে। ইন্ডি তখন সাংহাই। দুনিয়ার সবচাইতে বড় হিরাটি উদ্ধারের মিশনে। ক্রুর ষড়যন্ত্রকারী হত্যালুলুপ লোভী চায়নাদের হাত থেকে সে হিরা এবং সাদা নারী দুটিকেই হলিউডি  কৌশলে উদ্ধার করে বিমানে উড়াল দেয়। কিন্তু চায়নাদের নিষ্ঠুরতার এখানেই শেষ নয়। যেই মারামারিতে পরিশ্রান্ত ইন্ডি ঘুমিয়ে পড়েছে। বিমানের চায়নিজ ক্রু ও পাইলট তাদেরকে বিমানে ঘুমন্ত অবস্থায় ফেলেই প্যারাসুট নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে। অনিবার্যভাবে বিমান দুর্ঘটনা।
কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার আগেই ইন্ডিও সখিসমেত ঝাপিয়ে পড়ে বিমান থেকে। তারা বরফের পর্বতের ওপর পড়ে পিছলে যায়। এই বরফের রাস্তাই তাদের নিয়ে আসে ভারতবর্ষে। 

ভারতে ইন্ডির যে অভিজ্ঞতা হল তা যে কোনো ভয়ংকর কল্পনাকেও হার মানায়। ভারতে এসেই ইন্ডি দেখতে পায় অন্ধ বিশ্বাসী হাড় জিরজিরে গরীব লোকদের যারা একজন অবতারের জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের দিয়া স্পিলবার্গ এই বাসনার জন্ম দেন যে ইন্ডিই সেই অবতার। ইন্ডির সিনা ফুলে উঠে।
প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াত খেতে গিয়ে আরেক কা-। একি!  খাবার প্লেটে এতবড় বাচ্চা পেটের অজগর! হবে না ভারতীয়রাতো জীবন্ত অজগর খেতে খুব পছন্দ করে। এই রাজকীয় ভোজে ভারতের উজির নাজিররা খুব মজা করে অজগরের পেট কেটে কিলবিল করা কালো মসৃণ অজগরের বাচ্চাগুলা দুহাতে ধরে ধরে মজা করে কামড়ে খাচ্ছে। ইন্ডির চক্ষু ছানাবড়া হলেও সে অবাক হবার বা ভয় পাবার লোক নয়। কেবল ইন্ডির শ্বেতাঙ্গিনী সখির মাথা ঘুরছে সাপ দেখে। তাই সে একটু সামান্য সুপ চায় পরিবেশকদের কাছে। ধুমায়িত বাটিতে চামচ দিয়ে দেখে আরেক কাণ্ড একি! ভারতীয়রা মরামানুষের চোখের সুপ খায়? এবার সত্যি সত্যি মহিলা মুর্চ্ছা যায়। ভারতীয়রা এরপর খেতে থাকে একে একে তেলাপোকা ভাজি, বড় বড় মাকড়শা রেসিপি ইত্যাদি। 
তবে স্পিলবার্গের খাদ্য চিন্তা চমৎকারা বলতেই হয়। খাদ্যভক্ষণ শেষে ভারতিয়রা কি খায় জানেন? সদ্য কাটা বানরের মাথার গরম গরম মগজ। এই নিস্পাপ আমেরিকান ইন্ডিরা এই সব সভ্যতা বিরোধী কাজকর্ম দেখে অবাক মানে। শুধু ইন্ডি নয় দর্শকরা আমরা যারা ছবিটা দেখছি তাদেরও ভারতয়িদের প্রতি ঘৃণায় কুচকে যায় কপাল। আর ইন্ডির মত নিস্পাপ শুভ’র প্রতিনিধির জন্য মমতায় ভরে উঠে মন। হলিউডের বেশিরভাগ সিনেমায় বাস্তবতাকে উল্টে দেয়া হয়। মানে দুনিয়াব্যাপি আমেরিকানদের যেই হিংস্র সাম্রাজ্যবাদি চরিত্র, তাকে তারা বলে আবিস্কার। সিনেমায় নিরীহ দুর্বল অন্যমহাদেশকে এত খল করে দেখানোর ভেতর তাদের অবতার হয়ে উঠার সুক্ষ রাজনীতি জড়িত আছে।দুনিয়াব্যাপী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সামাজীকিকরণ ঘটানো হয় পরিকল্পিতভাবে হলিউডে। মানুষ নেহায়েত বিনোদন হিসাবে দেখতে গিয়ে নিজের ধ্যান ধারণা হারায় হলিউডের হাতে।

না, এখনো শুরুই হয়নি অসভ্য ভারতিয়দের হিংস্রতা। ভারতিয় বাজারি  ছবির জনপ্রিয় অভিনেতা অমরেশপুরী এক ভয়ংকর দৈত্য (বলরাম) যার মাথায় সবসময় ষাড়ের শিংয়ের ট্রুপ। আর মুখে মা কালির নাম। এমন দৈত্য কে দেখেছে আগে? যে জীবন্ত মানুষের বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে হাতের মুঠোয় কলিজা নিয়ে খুশিতে চীৎকার করে বলে ‘আব ইসকি জান মেরি মুট্টি মে হ্যায়, মা কালী...’। 
তার পর সেই লোকটিকে আগুনের ভেতর আস্তে আস্তে নামিয়ে দেয়া হয়। সে এক বিভৎস দৃশ্য। এমন ভয়ানক দৃশ্য কে দেখেছে স্পিলবার্গের আগে।
এই ছবির সবচাইতে মজার দৃশ্য শেষ দৃশ্য। ইন্ডি ভারতের আপমর জনতাকে অমরেশপুরির হাত থেকে রক্ষা করার মিশনে নামে। মা কালির মনিমুক্তা নিয়ে পালানোর পথে আবার দলবলসহ অমরেশপুরী ঝাপিয়ে পড়ে ইন্ডির ওপর। একটা সেতুর দুইদিক থেকেই ভারতিয়রা আক্রমণ করে ইন্ডিকে। এই সেতু এমন এক নদীর ওপর যার নীচে কিলবিল করছে ভয়ংকর কুমির। ইন্ডির এই বিপদ দেখে ভারত শাসনরত ব্রিটিশ সৈন্যরা ইন্ডির পক্ষ হয়ে যুদ্ধ শুরু করে। একদিকে তীর-ধনুক নিয়ে হাস্যকর ভারতিয় সৈনিক অন্যদিকে বন্দুক হাতে ব্রিটিশ সৈন্য। শেষমেষ ইন্ডিই জিতবে এটাতো হলিউডের আইন।
শুধু স্পিলবার্গ নয় হলিউডের এই সিনেমা ব্যবসায়ের সাথে জড়িত যেই মিডিয়ামোগলরা তারাও কর্পোরেটোক্রেসির অংশ। তাদের এই ‘অপর’ তৈরির যে নীলনকশা তা হারহামেশাই সংস্কৃতির মাধ্যমগুলাতে সাটা থাকে। এই যে ‘অপর’ মানে টেররিস্ট। আর নিজে অ্যান্টিটেররিস্ট। এই জন্য হলিউডের বেশিরভাগ ভিলেন থাকে এই অপর। রাশিয়ান কমিউনিস্ট অথবা কিউবান কমিউনিস্ট  অথবা মধ্যপ্রাচ্যের কোনো মুসলমান। অর্থাৎ দুনিয়াকে লুট করতে গিয়ে যাদের কাছে তারা বাধা পায়। তারাই তাদের অপর। হলিউডি সিনেমা ব্যবসার অন্তরালে মূলত এই অপর তৈরির সংস্কৃতিক নীলনকশা।

যাইহোক একজন আমেরিকান হিসাবে স্পিলবার্গ যে বিশ্বস্ত দেশপ্রেমিক সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নাই। আর বিশ্বস্ত আমেরিকান মানে একজন অ্যান্টিটেররিস্ট যিনি টেররিজমের মাধ্যমেই তাকে বধ করে। একজন ইন্ডি বা স্পিলবার্গের মনের ভেতর লুকানো জিনিসটাকেই বলে সাম্রাজ্যের বাসনা বা সাম্রাজ্যের মন।  রেইডার্স অব দি লস্ট আর্ক টেম্পল অব ধুম ছবি দুটিতে ইন্ডির চরিত্রটা বিশ্লেষণ করলে কিন্তু পুরা সাম্রাজ্যের মনটাকে বুঝতে পারা যায়।

ইন্ডি একজন আর্কিওলজিস্ট। যে কোন দুর্লভ সংগ্রহের জন্য সে এক পায়ে খাঁড়া। প্রথম ছবিতে বাদশাহ সোলেমানের যাদুর বাকসোটা যেটার ভেতর নাকি অমর হবার রশ্মি লুকায়িত আছে। যার জন্য স্বয়ং ফুয়েরার হিটলার পাগল। নাজিরা দুনিয়াটা চষে ফেলছে বস্তুটির জন্য। তা শেষ পর্যন্ত ইন্ডিই বগলদাবা করে। অবশেষে সেটা যখন আবার নাজিরা দখল করে তখন দেখা যায় সেই যাদুর বাকসোর ভেতর হতে বের হওয়া রশ্মিতে  নাজিরাই পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। 

স্পিলবার্গ ইহুদির সন্তান। নাজিবিরোধীতা তার রক্তে। কিন্তু এই চলচ্চিত্রে সু আর কু এর যুদ্ধে ইন্ডি হচ্ছে সু আর শক্তির অধিকারি, বাকীসব কু আর অশুভশক্তির প্রতিনিধি। এই ছবিতে দেখানো এশিয়া আর আফ্রিকার মানুষদেরকে নাজিদের একই লাইনে এসে শেষতক এমন এক সিদ্ধান্তে দর্শক আসে যে নাজি আর এশিয়া-আফ্রিকানদের তথা প্রাচ্যেবাসীদের মধ্যে কোন তফাৎ নাই। তারা সবাই ইন্ডি বা আমেরিকানদের মত সহজ সরল মানুষদের হত্যা করতে চায়। 

ইন্ডিয়ানদের যে খাদ্য তালিকা টেম্পল অব ধুমে দেখানো হয় তাও প্রাচ্যবাসিদের রাক্ষসের সমকক্ষ করে। এমন উপাদান দিয়ে ছবি গুলো বানানো হয়, স্পিলবার্গের অধিকাংশ ছবিই স্বপরিবারে একসাথে দেখার মত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে স্পিলবার্গে মত আবেগী, দক্ষ, জনপ্রিয় একজন পরিচালক যার ছবি শত শত ইউরোপ আমেরিকার শিশুদের প্রিয়। তারা কি ভাবছে এই সব ছবি দেখে সে কথা তিনি যে জানতেন না তা তো নয়। বরং তিনি উল্লসিত ছিলেন। এবং খুব সুক্ষভাবে এই কাজ তিনি করেছেন, 'অপর'কে শনাক্ত করার বাসনায়। কারন তার মত ডিটেলে কাজ  করে এরকম পরিচালক জগতে খুব কম। এই ডিটেলস নিয়ে চিন্তা করার সময়। প্রত্যেকটা সিকোয়েন্সের কথা তিনি ভেবেছেন, প্রত্যেকটা সিকোয়েন্সের, ফ্রেমের, গতির প্রতিক্রিয়ার কথা তিনি ভেবেছেন। তার রাজনীতির সচেতনতা প্রতিটি শটেই প্রমাণিত। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে স্পিলবার্গকে বলা হয় নীতিবাদি পরিচালক। তার প্রায় ছবিতে অভিনেতা বা মুটিভ অমানবিক এক শক্তির কাছে নিজের নিরাপত্তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে আবার নিজের চেষ্টায় তা ফিরে পায়। কিন্তু পৃথিবীতে সব সময় দুই শ্রেণির মানুষের নীতি দুই রকম। একজন আমেরিকান হিসাবে স্পিলবার্গের যে নীতি তা প্রাচ্যের একজন চলচ্চিত্রকারের একই নীতি নয় নি:সন্দেহে। 

আর তাই ইন্ডিয়ানা জোন্সের নীতি আর চীন ভারত মিশরের তথা প্রাচ্যে নীতি একরকম নয়। প্রাচ্যের চোখে ইন্ডি একজন লোলুপ কিডন্যাপার ছাড়া কিছু নয়। যেভাবে প্রাচ্য দেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে।। যেভাবে আমরা আজ দেখছি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে। স্পিলবার্গও বুঝেছেন যে এটাই সত্য আর তাই তাকে মিশরি বা ভারতিয়দের খারাপ বানাতে হয় তার মুভিম্যাজিকের মাধ্যমে যেন যারা প্রাচ্য সম্পর্কে জানেনা তারা প্রাচ্যের খারাবি সম্পর্কে তথা 'অপর’এর স্বভাব ও শনাক্তি সম্পর্কে যেন কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারে। এটাই সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক রাজনীতি বা অপর শনাক্তের নীতি। প্রকারান্তরে এই ছবি দুটোর মানসিকতাই হয়ে উঠে সাম্রাজ্যবাদিদের লাস্ট ক্রুসেডের মেটাফোর।