Thursday, April 11, 2013

যুদ্ধাপরাধ বনাম ব্লাসফেমি


ঘটনা মাত্রেরই প্রতিক্রিয়া অনিবার্য। মুক্তিযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীর বিচারের বদলে সাধারণ ক্ষমা যেমন আজ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য বিষফোড়ায় পরিণত হয়েছে। তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ৪০ বছর পর প্রগতিশীল পেটি বুর্জোয়া তারুণ্যের জাগরণও জন্ম দিয়েছে অন্য সম্ভাবনার। যেমন কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন মেনে নিতে না পারার কারণে যাবজ্জীবনের বদলে ফাঁসি চেয়ে তরুণদের যাত্রা শুরু। কিন্তু এইরকম এক যুদ্ধাপরাধীর কেন ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন দিয়েছিল তথাকথিত প্রগতিশীল আওয়ামী লীগ সরকার! মূলত একাত্তরের পরে পাকিস্তান মার্কিনি লবি যুদ্ধের মাঠে পরাজিত হলেও যুদ্ধের মানে চক্রান্তের টেবিল ছাড়ে নাই। যেই আন্তর্জাতিক চাপের কারণে মুজিব রাজাকারদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন সেই একই কারণেই কি শেখ হাসিনা সরকার কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন দিয়েছিলেন। 

এর ভেতর থেকে জেগে উঠা অসন্তোষই আজকের গণজাগরণ মঞ্চ। কিন্তু গণজাগরণ মঞ্চ যেই দাবি নিয়া মাঠে নেমেছিল যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি। তা সাঈদীর ফাঁসির আদেশের ভেতর দিয়ে বিজয়ে পরিণত হয়। এবং একই সাথে যুদ্ধাপরাধী মৌলবাদি দল হিসাবে জামাতের টিকে থাকাকেও চ্যালেঞ্চের মুখে ফেলে দেয়। কারণ জামাতের অন্যান্য নেতার সাথে সাঈদীর খানিক পার্থক্য আছে। সাঈদী প্রকাশ্যে জামাতে ইসলামির ব্যানারে আসার আগে এদেশের সাধারণ মুসলিমদের প্রিয় ধর্মীয় ভাষ্যকারে পরিণত হয়। দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর ওয়াজ কানে না শুনলেও রেকর্ডে শোনে নাই সেরকম মুসলিম নাই বাংলাদেশে। সাঈদীর জনপ্রিয়তার পুরাটাই ব্যবহার করতে পেরেছিল জামায়াতে ইসলামী।

ফলে সাঈদীর ফাঁসি মেনে নেওয়া আর জামায়াতে ইসলামীর নিষিদ্ধ হয়ে যাবার মধ্যে তেমন কোনো দূরত্ব নাই। তাই জামাত যে মরিয়া হয়ে উঠবে সেই বিষয়ে যদি আওয়ামী বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ গণ আগাম ধারণা করতে না পারেন তাহলে তাদের দূরদর্শীতা নিয়ে সন্দেহ করবার যতেষ্ট অবকাশ থেকে যায়। শুধু তাই নয় যুদ্ধাপরাধের বিচার যে পক্ষান্তরে জামাত ধ্বংসেরই নামান্তর সেটাতো দিবালোকের মত সত্য। কারণ রাজাকারদের অধিকাংশই রাজনৈতিকভাবে জামায়াতে ইসলামীতে পুনর্বাসিত। শুধু তাই নয় রাজনীতি সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন জামায়াতে ইসলামী দেশটাকে আবার পাকিস্তান তথা বাংলাস্থান বানানোর সব ধরনের পরিকল্পনা নিয়েই আগাচ্ছে। তাদের রয়েছে যতেষ্ট আর্থিক উৎস। গোটা দুনিয়া জুড়ে গড়ে উঠছে তাদের নেটওয়ার্ক। তাদের এই আর্থিক উৎস যেমন জামায়াতে ইসলামীর নির্ভেজাল কর্মী দিয়ে পরিচালিত হয় তেমনি এর আর্থিক লাভবানও হয় জামাতের কর্মীগণ। ফলে জামায়াতে কর্মীদের বেঁচে থাকার কাজ আর আদর্শের কাজ আসলে একই। ‘জামায়াতে ইসলামী’ দলটি আজ জামাতশিবিরের বেঁচে থাকার ও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাসের উৎস।

এত স্বল্পসময়ে জামাতের এত প্রসারের পেছনে খানিক পুঁজিতান্ত্রিক ইন্ধন আছে। কার্লমার্কস যে কারণে ধর্মকে আফিম বলেছিলেন। অর্থাৎ যন্ত্রণা রোধক। বুর্জোয়াদের শোষকযন্ত্রের যন্ত্রণার ভেতর ধর্ম যেন খানিকটা তাদের ব্যাথা রোধ করে। কারণ ধর্ম বলে তাদের এই যে যন্ত্রণা এটা তাদের পাপের ফল অথবা ইশ্বর মোমিনদেরকে পরীক্ষা করছেন। কারণ এই দুনিয়া কষ্টের, এই দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আর তাই এই যন্ত্রণা  তাদের নিয়ে যাবে মৃত্যুর পর আসল দুনিয়ায়। অর্থাৎ বেহেস্তে। ফলে সাধারণ শোষিত মানুষ এই কষ্টের দুনিয়া ছেড়ে যাবার জন্য আকুল হয়ে থাকে। তার উপর যদি সেটা হয় ধর্মের শত্রুদের খতম করার মত কাজ তাহলেতো বেহেস্ত অনিবার্য। কারণ বাংলাদেশের আওয়ামী বা জাতীয়তাবাদি বুর্জোয়াদের  শোষণের হাত থেকে বাঁচার তাদের সামনে আর কোনো পথ আপাতত খোলা নাই। 

তবে এইসব সাধারণ মুসলিমদের এইরকম অশিক্ষিত করে রাখার জন্য বুর্জোয়াদের শিক্ষাব্যবস্থাই দায়ি। দেশের ভাল ভাল স্কুল কলেজে বিদেশের স্কুল কলেজে ভাল ভাল শিক্ষা এই সব বুর্জোয়াদের ছেলেপিলেরাই পায়। আর গরীবদেরকে প্রগতিহীন চেতনাহীন সুবিধাবঞ্চিত রাখার জন্য রয়েছে মসজিদ, মাদ্রাসা আর  মান্ধাত্বার আমলের শিক্ষা ব্যবস্থা। যেখানে পড়ে চলমান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কোনো কাজে তারা আসতে পারে না। খুব দ্রুত এই সব গরীর মুসলমান তথাকথিত প্রগতিশীল বুর্জোয়াদের বিপক্ষে যে নিজেদের দাঁড় করাবে তাতে আর সন্দেহ কি? বুর্জোয়ারা যেই ভোগের জীবন যাপন করে তাকে যে তারা ঘৃণা করবে, বুর্জোয়াদের ভোগের সংস্কৃতিকে যে তারা বেদাত বলবে তাতে সন্দেহ নাই। ধর্মীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষ এমনি এমনি হয় না। একটা জনগোষ্ঠীকে এটার ভেতর রেখে দেওয়া হয়। এবং সেই বঞ্চনা থেকেই জন্ম নিতে থাকে ঘৃণা। 

ফলে সে সব প্রগতিশীল স্কুলে বুর্জোয়া পেটিবুর্জোয়ারা লেখাপড়া করে আজ ধর্মের সমালোচনাসহ গণতান্ত্রিক ন্যায়বিচারের কথা বলা হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার দাবি আন্দোলনের মাধ্যমে, ঠিক একই জায়গার অপর পিঠ থেকেই আসছে ব্লাসফেমি আইনের দাবি। কারণ যুদ্ধাপরাধীর বিচার করতে গেলে জামাত নিষিদ্ধ করতে হবে। জামাত নিষিদ্ধ মানে এদেশে গরীব মুসলমানদের ধর্মভিত্তিক সংগঠন নিষিদ্ধকরণ। তো সেটাকে সাধারণ মুসলমান তাদের সর্বশেষ আশ্রয় হারিয়ে ফেলাই মনে করছে। মানে আমাদের শোষণবঞ্চনা ছাড়াতো আর কিছু নাই এখন ধর্মটাও যদি হারিয়ে যায় তাহলে আমাদের আর কি থাকলো। এখন জামাত আদৌ ধর্মভিত্তিক সংগঠন কিনা নাকি তারা ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে তৎপর সেইটা ভিন্ন বিষয়।

এখন জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিকভাবে সরাসরি প্রতিহত হবার কারণে তারা যে হাজার রকম পলিসি নিয়ে আগাবে সেটা রাজনীতি সচেতন মানুষ মাত্রেই জানে। হেফাজতে ইসলামীর ভেতর মিশে যেতে জামাতের পলিসিগত কারণে সময় লাগার কথা না। কারণ হিসাবে বলা যায় যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবির ভেতর দিয়ে যখন জামাত নিষিদ্ধের বিষয় আলোচিত হচ্ছে ঠিক সেই সময় হেফাজতে ইসলামের উত্থান। তারা এতদিন কোথায় ছিলেন? একাত্তরের লাখলাখ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা লাখ লাখ নারীদের ধর্ষণ বিষয়ে তাদের কোনো কথা নাই। কোরানে হাদিসে কোথায় লেখা আছে তা? একাত্তরের নিহতদের মধ্যে, ধর্ষিতদের মধ্যে অধিকাংশই মুসলমান সেই নিহত মুসলমানদের হত্যার দাবিতো কোনোদিন হেফাজতে ইসলামী করে নাই। যখন সেই বিচার চাইছে পেটিবুর্জোয়া তরুণ সমাজ তখন কেন তাদের ইসলামের প্রতি এত দরদ উৎলে উঠল?

যারা যুদ্ধাপরাধের বিচার চাইছে সেই সব তরুণদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে তারা নাস্তিক। কারণ নাস্তিকতা শব্দটি এদেশের সাধারণ মুসলমানের মর্মমূলে গিয়ে আঘাত করে। কারণ তাদের ধর্ম ছাড়া আর কিছু নাই। সেই যন্ত্রণারোধক ধর্মকেই যারা স্বীকার করে না তাদের বিষয়ে কোনো আপোষ করবে না সাধারণ মুসলাম। সেই সুযোগই গ্রহণ করছে জামায়াতে ইসলামী। এরজন্য দরকার হলে তরুণদের নামে ব্লগ খুলে নিজেরাই এমন পোষ্ট দেবে যাতে মানুষকে আরো উত্তেজিত করা যায়। এটাও প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার একটা রাজনৈতিক কৌশল। যখন তরুণরা রাজাকারদের ফাঁসি চাইছে। তখন হেফাজতে ইসলাম নাস্তিক অপরাধে সেই তরুণদেরই ফাঁসি চাইছে। যখন তরুণরা জামাত নিষিদ্ধের আইন চাইছে তখন হেফাজত ব্লাসফেমি আইন চাইছে। এসব লক্ষণ দেখে সহজেই অনুমান করা যায় হেফাজতে ইসলামের পেছনে কাদের ইন্ধন আছে।

অন্যদিকে শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাওয়া জনবিচ্ছিন্ন পেটিবুর্জোয়া তরুণরা যাদের আন্দোলনে জনভিত্তিক কোনো এজেন্ডা নাই। এই মঞ্চে আওয়ামী লীগ মন্ত্রীরা এসে একাত্ততা প্রকাশ করে গেছে। এটার পেছনে যে আওয়ামী লীগ কলকাঠি নেড়েছে তা ষ্পষ্ট। কিন্তু আওয়ামী লীগ যে এই মঞ্চ রক্ষা করবে না তাতো ব্লগারদের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হওয়া শুরু করেছে। কারণ নাস্তিকতা এমন এক অপপ্রচার যা রাজাকার প্রসঙ্গকে ঢেকে দিতে পারে। খোদ মুসলিম আওয়ামী লীগারদের ভেতরও একজন মুসলমান বাস করে। তারাও মেনে নেবে না। নাস্তিক নামে যাদের গ্রেপ্তার করা হবে আওয়ামী লীগাররাও কিছুদিন পর তাদের বিচার চাইবে। কারণ আওয়ামী লীগ বিএনপি হচ্ছে ব্যবসায়ী দল। তাদের অধিকাংশ ভোক্তা যদি সাধারণ মুসলমান হয় তাহলে তাদেরকে তারা আঘাততো করবেই না বরং তাদের দাবিকেই নিজেদের দাবিতে পরিণত করলেই তাদের ভোটব্যাংক ভরে উঠবে।


 

আদি টোটেম সমাজ ও সাম্প্রদায়িকতার অভেদ সন্ধান


সাম্প্রদায়িকতা  নিয়া বেশ লেখার চল হয়েছে। বিশেষ করে কক্সবাজার জেলায় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলার পর। বেশির ভাগই প্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা মনে হচ্ছে। কত সাল থেকে কোন দেশে বা কোন মহাদেশে সাম্প্রদায়িকতা শুরু সেই টাইপের। মনে হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা যেন হঠাৎ করে নাজিল হয়। হঠাৎ করে যেন কিছু মানুষ উম্মত্ত পাগল হয়ে উঠে। যেন স্রেফ সেই মানুষগুলাই দায়ী এর জন্য। যেন যুগ শতাব্দী ধরে মানুষ এসব বহন করে চলছে না তাদের রক্তে। এক তরুণ প্রাবন্ধিক দেখলাম টিভিতে বলছেন, দুদিক থেকেই সমানে সংঘর্ষ হলেই কেবল তাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলা যায়। কিন্তু অধিকাংশ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাই দেখা যায় সংখ্যাগুরুরা সংখ্যালঘুর উপর সেটা চাপিয়ে দেয় মাত্র। নিশ্বেষ হতে হতে প্রতিরোধের চেষ্টাই কেবল করে সংখ্যালঘুরা, যদিও তারা নিজেরাই জানে তারা ব্যর্থ হবে। তবু প্রাণিকুলের বৈশিষ্টই এটা, মৃত্যুর শেষ মুহুর্তেও ঘুরে দাঁড়ানো চেষ্টা। একে কি সংঘাত বলা যাবে? সেটা সার্বিয়া, গুজরাত, বর্তমান মধ্যপ্রাচ্যে, বার্মায়, বাংলাদেশের দিকে তাকালেই অনুধাবন করতে পারবো আমরা।

 ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক জা জাক আনুই একটা সিনেমা বানিয়েছিলেন যার নাম 'কোয়েস্ট ফর ফায়ার'।নিয়ানডারথাল মানুষকেই প্রথম আগুনের আবিষ্কারক ও ব্যবহারকারী হিসাবে ধরা হয়। সেই সময়টা নিয়াই তিনি সিনেমাটা বানিয়েছিলেন। যেহেতু সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে আগুনের প্রভূত ব্যবহার আমাদের নজর কাড়ে তাই আগুনের সূত্রপাতের মনস্তত্বের দিকে তাকালে মনে হয় তার খানিকটা নিশানা পাওয়া যেতে পারে। তখন সম্প্রদায় হিসাবে মানুষ একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। বাকী জীবজন্তু ছিল 'অপর' সম্প্রদায়। তো মহাত্মা আনুই দেখাচ্ছেন সেই যুগ আন্ধারের যুগ। সেই যুগ শিকার মনোবৃত্তির যুগ। মানুষ ঘুরছে বনে বাদাড়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রাণির খোঁজে। কারণ সেসব খেয়েই মানুষ বাঁচে। আর মানুষের চেয়েও হিংস্র প্রাণিরা ঘুরছে মানুষের খোঁজে। দুই ধরণের পশুই মানুষের কাছে 'অপর' এ পরিণত হয়। দুর্বল পশু তাদের খাদ্য হিসাবে বধ্য, সবল পশু তাদের শত্রু হিসাবে। মানুষ এখনো যে কোনো পশু পাখিকে 'অপর' হিসাবে চিহিৃত করে থাকে। প্রশ্ন উঠতে পারে বর্তমানে অনেক মানুষই তো পোষ্য হিসাবে বিভিন্ন পশু পাখি দত্তক নেয়। সেইটাও আসলে হত্যার চেয়ে মারাত্বক। চেন বাধা কুকুর বা খাঁচাবন্দি পাখি নিহত পশুর চেয়েও খানিকটা বিপদগ্রস্থ। যাইহোক যে কোনো পশুকে সে বধযোগ্য মনে করে। সেই দেখার দৃষ্টিকোণ মানুষ এখনো ত্যাগ করতে পারে নাই, ভবিষ্যতেও পারবে কিনা সন্দেহ। 

আরেক বিজ্ঞানী কার্ল সাগান মানুষের এই মনোবৃত্তির নাম রেখেছিলেন 'আর কমপ্লেক্স'।তিনি মানুষের মস্তিকে একধরনের কর্টেক্সকে চিহিৃত করেছিলেন যেগুলা কিনা এই শিকার মনোবৃত্তির জন্য দায়ী। আবার শিকারের বা বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই মস্তিস্তে এই কর্টেক্সের বিকাশ ঘটেছে। যাই হোক সিনেমায় ফেরা যাক। কিন্তু যে কোনো ভাবেই একখণ্ড আগুন যখন মানুষের হাতে চলে আসল তখন সেটা পরিণত হলো শক্তিতে। সবল প্রাণিরাও সেটারে ভয় পেতে থাকলো। তারাও নির্বিচারে মানুষের উপর আক্রমণ করতে বিবেচনার পরিচয় দিতে থাকলো। আর যারা এখনো আগুন আয়ত্ব করতে পারে নাই। তারা সেই আগুন দখল করতে সচেষ্ট হলো। আগুনকে নিয়া বা তাকে বাঁচানোর সাধনাই হয়ে দাঁড়াল নিয়ানডারথাল মানবের পহেলা ইসু। এখনো মানবজাতির পহেলা ইসু সেই জ্বালানি। জ্বালানি দখলই দুনিয়া দখলের পরকাষ্ঠা। এই সেই আগুন যা মানবজাতিকে এই অগ্নিসভ্যতা উপহার দিয়েছে।

সিনেমাটা ঘোরের মত, সেখানে দেখা যাচ্ছে। অন্ধকারযুগে অন্যহিংস্র প্রাণিরা দুর্বল প্রাণিদের আড়ালে সুযোগের জন্য অপেক্ষা করছে। সুযোগ পেলেই ঘাড় মটকে দিচ্ছে। আবার মানুষ দলবদ্ধভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে দুর্বল প্রাণিদের খোঁজে যাদের খেয়ে তারা বাঁচবে। পথে এমনও মানুষজাতির সাথে তাদের দেখা হয়েছে যারা নরভোগ্য। তো এমন কিছু হিংস্র মানুষেরই আক্রমণে আগুনটা হারিয়ে ফেলে এক টোটেম সদস্যরা। তারা আগুন জ্বালাতে ব্যর্থ হয়ে ফের বেরিয়ে পড়ে আগুনের খোঁজে। একেকটা টোটেম সমাজের পুরা যাত্রাই হয়ে দাঁড়ায় আগুনের জন্য যাত্রা। শেষে অনেক বিপদ আপদ বেরিয়ে তারা অপেক্ষাকৃত এক দুর্বল টোটেম সদস্যদের হাতে বন্দি হয়। কিন্তু বুদ্ধিতে সেই টোটেম সদস্যরা অনেক এগিয়ে। যেমন আগুনের খুব সহজ ব্যবহার তারা শিখে নিয়েছে। যেই টোটেম সদস্যরা আনুইজির সিনেমার নায়কের ভূমিকায় তারা অবাক হয়ে যায়। এত সহজে আগুন জ্বালানো যায়? যাইহোক তারা আগুনের ব্যবহার শিখে নিজ এলাকায় ফিরে আসে ও সেই এলাকা পরিণত হয় তাদের অভায়ারণ্যে। আর পশুদের জন্য আতংকের জনপদ। 

যাইহোক সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে কথা বলতে সামান্য ভনিতা করতে হলো কারণ মানুষের পেরিয়ে আসার সেই আদ্ধিকাল থেকে মানে তাদের অরিজিনগত স্বভাব থেকে তারাও সামান্যও এদিক সেদিক যেতে পারে নাই। সেই টোটেম যুদ্ধকেই আমরা নাম দিয়েছি সাম্প্রদায়িক সংঘাত বা দাঙ্গা। আমাদের ধর্মবিশ্বাস সেই টোটেমদের নানান পুজা, অর্চনা, প্রার্থনা ও ভীতির সমন্বয়মাত্র। যা পরে হয়ে উঠেছে পুঁজিবাদি আর সাম্রাজ্যবাদিদের সবচেয়ে বড় শোষণের হাতিয়ার।

রামুতে ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন প্রসঙ্গেই এই লেখা। ধ্বংশযজ্ঞ পুরাটাই আমি পায়ে হেঁটে দেখেছি। লোকজনের সাথে কথা বলেছি। সেই সূত্রে রামুতে ধ্বংশযজ্ঞের ভেতর দাঁড়িয়ে আমি যেভাবে গ্রন্থিত হয়েছি ইতিহাস, ধর্ম ও বিশ্বরাজনীতির সাথে তার আলোকেই ব্যাপারটা দেখতে চাই। ধর্মই আসলে প্রথম আন্তর্জাতিক ভাবনা। রাজনৈতিকও। ধর্মকে যতই অরাজনৈতিক আখ্যা দিয়ে আড়ালে রাখার চেষ্টা হোক সেইটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক এজেন্ডা। দুনিয়ার প্রতিটি ধর্মের বিকাশের পথ রক্তাক্ত ও সাম্রাজ্যবাদিতার লক্ষণাক্রান্ত। যেহেতু এই ধর্ম নিয়া সচেতনভাবে মানুষ মধ্যযুগ থেকে অনেক বার রক্তাক্তভাবে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করেছে। স্বভাবত দুর্বল মানুষেরা যারা আত্মরক্ষার কলাকৌশলগুলাও শিখতে পারে নাই, বিশেষ করে তৃতীয়বিশ্বে সেখানে ধর্ম খানিকটা বেঁচে থাকার আশ্রয়ও। মার্কস যাকে আফিম হিসাবে আখ্যা দিয়েছিলেন। কেননা ইশ্বরের নামে সমস্ত শোষকের অত্যাচারই মানুষ দাঁত খিলিয়ে সহ্য করে যায়। ধর্মবোধের নিয়তিকেই যদি মানুষ তার অপরিবর্তনীয় জীবন হিসাবে মেনে নেয় তাহলে পুঁজিবাদের জন্য এরচেয়ে সুখবর আর কি হতে পারে।

তো সেই ধর্মের আন্তর্জাতিক চেহারা খানিকটা এরকম, গোটা ইউরোপ, আমেরিকা প্রায় সমগ্র অঞ্চল যিশুখ্রিষ্টের অনুসারী। আফ্রিকার অর্ধেকেরও বেশি, এশিয়ার অর্ধেক প্রায় মুহাম্মদের অনুসারী, এশিয়ার বাকী অর্ধেক হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ইজরায়েল গোটা ও অন্যান্য উন্নত বিশ্বে ছড়িয়ে আছে ইহুদিরা। অর্থনৈতিক তাড়নায় বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা আবার নিজ দেশে থিতু নাই তারা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। কিন্তু নেটিভ হিসাবে যেই ধর্মালম্বীদের বাস সেখানে সংখ্যাগরিষ্টের ধর্মের ভিত্তিতেই আমরা অঞ্চলটাকে দেখতে অভ্যস্ত। উদারহরন হিসাবে দেখা যেতে পারে। ভারত হিন্দু রাষ্ট্র, পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র, বার্মা বৌদ্ধ রাষ্ট্র, ইজরাইল ইহুদি রাষ্ট্র, ইউরোপ খ্রীস্টান মহাদেশ ইত্যাদি। কিন্তু এইসব দেশ স্ব স্ব ধর্মীয় জাতীয়তাবাদে বা সম্প্রদায়ে বিভক্ত হলেও সেসবে দেশের সংখ্যালঘু হিসাবে অন্যান্য সম্প্রদায়ের বসবাস রয়েছে। যেমন ভারতে মুসলমান, পাকিস্তান বা বাংলাদেশে হিন্দু, বৌদ্ধ, বার্মায় মুসলমান ইত্যাদি।

অখণ্ড ভ্রাতৃত্যবোধের কথা প্রায় সব ধর্মেই বলা হয়। যেমন মুসলমান মুসলমান ভাই, খ্রিস্টান খ্রিস্টান ভাই, হিন্দু হিন্দু ভাই জাতীয় এক অলিখিত স্ব স্ব ইশ্বরকেন্দ্রিক, আন্তর্জাতিক ধর্মীয় আচার সর্বস্বতা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গোটা দুনিয়ার ধর্মীয় সম্প্রদায়। একেক লাইন একেক দিকে টানা। এই ব্যাপারে বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলার সংবিধানও অকার্যকর। যেমন গুজরাতে যখন সংখ্যালঘু মুসলমান নিধন করা হয় সেটাকে আমরা শক্তিশালী টোটেম সমাজ কর্তৃক দুর্বল টোটেমকে আক্রমণ বা বড় মাছ কর্তৃক ছোট মাছকে খেয়ে ফেলা হিসাবে দেখতে পারি। যেহেতু রাষ্ট্রও বড় মাছের বা বড় টোটেমের সে ক্ষেত্রে তাদের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও যে আগ্রাসনেরই অংশীদার হবে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। গুজরাতে তা দেখা গেছে। নরেন্দ্র মোদির মত ক্ষমতাবানদের সমর্থনের মধ্য দিয়েই তা সম্ভব হয়েছে। স্বভাবতই খুন ধর্ষণ লুঠ ইত্যাদি খেয়ে ফেলার অর্ন্তভুক্ত। বাবরি মসজিদ ধ্বংশও সেইরকম।আবার আমেরিকা যখন একটার পর একটা মুসলিম বিশ্বে ধর্মযুদ্ধের নামে বোমা ঢেলে, চালকহীন বোমারু বিমানে মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলাকে মধ্যযুগে পাঠিয়ে দেয় তখনো আসলে সেই টোটেম সংস্কৃতিরই চর্চা হয়।আবার বার্মায় যখন আরাকানের মুসলমানদের গণহারে নিধন করা হয় সেখানেও সেই একই ব্যাপার। কিন্তু গুজরাতে যারা সংখ্যালঘূ নিধন করে, বার্মায় যারা সংখ্যালঘু নিধন করে তারা ভুলে যায় যে এই নিধন এখানেই শেষ নয়। এইখানে এসে এই ঘটনা আর বার্মা বা ভারতের লোকাল থাকে না সেটা রূপ নেয় আন্তর্জাতিকতায়। যার দায় শোধ করতে হয় ধর্মভিত্তিক। ধর্মের অশেষ পৃষ্টপোষকতা পুঁজিবাদের অন্যতম বিনিয়োগ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দিয়া পুঁজিবাদ অনেক বড় বড় ঘটনাকে ধামাচাপা দিতে পারে।

বেশ কিছুদিন হলো আরাকানে মুসলমানদের উপর ব্যাপকহারে একতরফা আগ্রাসন চালিয়েছে বার্মিজরা। বার্মিজরা যেহেতু বৌদ্ধাবলম্বী সেহেতু বাংলাদেশের   মুসলমানদের চোখে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়ায় যে বার্মায় বৌদ্ধরা মুসলমানদের হত্যা করছে। এদেশে বৌদ্ধরা নিরাপদ থাকে কিভাবে। 

এইখানে, যদি তর্ক তুলি বার্মা একটা আলাদা রাষ্ট্র তাদের দেশে কি হচ্ছে তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। এই সংবিধান এখানে অকার্যকর কারণ ধর্মের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃরূপ। যেহেতু আমরা সবরকমের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতারই বিরুদ্ধে তাই প্রশ্নটা জরুরি। এই জন্যই সাম্প্রদায়িক উস্কানি পুঁজিবাদিদের এত পছন্দের। প্রত্যেক সাম্প্রদায়িক সংঘাতে পেছনে কিছু মুটিভ দেখা দেয়। গুজরাতে সবরমতি এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগিয়ে হিন্দু নিধন করেছিল মুসলিমরা, বার্মায় এক বৌদ্ধ মহিলাকে ধর্ষণ করেছিল রোহিঙ্গারা, বিভিন্ন দেশে মার্কিন দূতাবাসে হামলা, রামুতে উত্তম নামে এক বড়ুয়া কর্তৃক ফেসবুকে কোরান অবমাননা ইত্যাদি। যদিও এসবই হাস্যকর অভিযোগ একটু চিন্তা বা তলিয়ে দেখলেই বুঝা যায় যে সংখ্যালঘুরা আত্মরক্ষার বাসনা নিয়াই সংখ্যাগরিষ্টের দেশে বাস করে। সেখানে বারবার তাদের আক্রমণ করার আগে তাদেরকেই আক্রমণাত্বক ভূমিকায় থাকতে বাধ্য করা হয়। ব্যাপারটা এমন যে আমরা এমনি এমনি মারি নাই, আগে আমাকে মেরেছে জাতীয় শিশুসুলভ অভিযোগ। 

ফলে সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন কিভাবে হয়েছের চাইতে জরুরি কেন হয়েছে তা সনাক্ত করা। কারণ আমরা ইতিমধ্যে জেনেছি সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন কিভাবে সবকিছু তছনছ করে দেয়। দুনিয়ার সব সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা রামুরটার চাইতে ভয়ানক ছিল। রামুতে শুধু ঘর ও মন্দির পোড়ানো হয়েছে। গুজরাতে আরাকানে মসজিদতো পোড়ানো হয়েছেই নারীদের গণহারে ধর্ষণ করা হয়েছে, পোয়াতিদের হত্যা করে নবজাতককে তলোয়ারে বিদ্ধ করা হয়েছে। হাত পা কেটে মানুষকে আগুনে দাহ করা হয়েছে। জীবন্ত মানুষের চোখে মুখে আগুন লাগিয়ে উল্লাস করা হয়েছে। ধর্মের কোথাও কি এইটা লেখা আছে? কিন্তু ধর্মকে যদি আদি টোটেম সমাজে স্থাপন করলে আমরা ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারবো।

মানুষ দুর্বল প্রাণি হওয়া স্বত্বেও প্রাণিজগতের  সমুদ্রের বা জঙ্গলের অন্যান্য সব জীবজন্তুকেই তার অধীনস্থ করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু প্রথমে আত্মরক্ষা পরে দখলদারিত্ব তার মজ্জাগত। তার সেই আগ্রাসী স্বভাবও সে ছাড়তে পারে নাই। এখন তার সেই আগ্রাসন বা হাতিয়ার সে অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করছে। এই সম্প্রদায় বিরোধিতা মানুষ সাল অনুযায়ী জন্ম দেয় নাই এইটা সে নিরন্তর বহন করছে। সাম্রাজ্যবাদিরা এইটাকে ব্যবহার করছে মাত্র।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যায়। আওয়ামীলীগার, জাতীয়তাবাদী দল বা জামাতিদের মধ্যে ধর্মীয় ভিত্তিতে কোনো ফারাক নাই। প্রত্যেক আওয়ামীলীগারের ভেতরও একেক জন জামাতের ক্ষুদ্র কর্মী বাস করে। জাতীয়তাবাদীদল তো ঘোষিত জামাত সমর্থক। কারণ তারা সবাই বস্তুত মুসলমান। ইসলাম অনুযায়ী সমস্ত আচারই তারা একসাথে পালন করে থাকেন।

তবে হঠাৎ করে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চল অস্থির হয়ে উঠার পেছনে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত কাজ করছে সন্দেহ নাই। বিভিন্ন ক্যাটাগরির মার্কিন সামরিক কর্মকর্তাদের আসাযাওয়া ও মার্কিন বিভিন্ন কমান্ড কোরের সদস্যদের সাথে বাংলাদেশি নৌ, সেনা ও বিমান বাহিনীর সাথে যৌথ মহড়া বা ট্রেইনিং ইত্যাদির মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে মার্কিন প্রভাব বাড়ানোর যে পদক্ষেপ তার পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবেও বার্মা ও রামুর এই ঘটনাকে দেখা যায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু সাম্রাজ্যবাদের এজেন্সি তারা মার্কিন যেকোনো এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য যেহেতু প্রতিযোগিতামূলকভাবে এগিয়ে আছে অন্যদিকে যেহেতু তারাও ভেতরে ভেতরে মুসলমান ধর্মীয় পরিচয় লালন করে সেহেতু আওয়ামীলীগ, বিএনপি জামাত কেউ সন্দেহের উর্ধ্বে থাকতে পারে না।

পুঁজিবাদ নিজের স্বার্থেই ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করে। অন্ধ ধর্মজীবীরা নিজের লাভ ও ধর্মের লাভ হিসাবে সাম্রাজ্যবাদীদের বুদ্ধি পরামর্শ সহযোগিতা ইত্যাদি নিয়া থাকে। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের দিকে তাকালে এই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাবে। শুধু আফগানিস্তান নয় প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের ধর্ম ও অঞ্চলভিত্তিক যে জাতীয়তাবাদের উত্থান সেই খেলার পুরা মাঠই নিয়ন্ত্রণে ছিল সিআ্ইএর। ধর্মের ধারণা যতদিন থাকবে ততদিন ধর্মীয় দাঙ্গাও বহাল থাকবে মহাতবিয়তে। নিজের গরজেই ধর্মের সহায়তা করে যাবে পুঁজিবাদ। সংখ্যালঘুত্বের যে শুধু ধর্মীয় চরিত্রই কেবল আছে তা না। সমাজের দুর্বল মানুষও সংখ্যাগরিষ্ট হয়েও সংখ্যালঘিষ্ট। নিরন্তর স্থানীয় পুঁজিবাদীরা, লুম্পেনরা সমাজের দুর্বল মানুষের জমাজমি ব্যবসা নিয়ত দখল করে চলেছে। তাতে রাষ্ট্রের সায়তো বটেই সহযোগিতাও আছে। সমাজে ঘটে যাওয়া নিরন্তর যে উচ্ছেদেরে ঘটনা তাতে জনমনে, জনমনের অজান্তেই এক নৈরাজ্যিক রাষ্ট্রবাসনার জন্ম দেয়। জনমন জানে সে বাস করে মূলত ক্ষমতার কেন্দ্রের ভেতর নৈরাজ্যে। রাষ্ট্র বা তার পেশাদার পরামর্শক বা লিখিয়েরা যা বলে তার সিংহভাগই মিছাকথা, বাগড়ম্বর, প্রতারণা। আর আশাবাদী সরকারি কর্মকর্তারা যারা নিয়ত মিডিয়ার সামনে উন্নয়ন আর দেশপ্রেমের হাস্যকর পদ্য বলে সে সব আসলে কোনো কাজেই আসে না। ফলে যে কোনো নাসকতার বিশেষ করে গণনাসকাতার গন্ধ পেলেই তার শোষক রাষ্ট্রটাকে অকেজো করে দিতে চায় জনমন। ফলে স্ফুলিঙ্গের মত এই জনস্রোত ব্যবহৃত হবার জন্য উন্মুখ সারাবিশ্বে।

এই শোষিত বঞ্চিত জনস্রোত ধর্মান্ধতার ভেতর, অশিক্ষার ভেতর, অনন্ত নৈরাজ্যের ভেতর ধরে রাখার যেই রাজনীতি সেখানে দৃষ্টি দেয়া ছাড়া উপায় নাই। যে প্রশ্নের হাত ধরে আসবে সমাজ পরিবর্তনের প্রসঙ্গও।এই ব্যাপারে মার্কসের প্রস্তাব ভেবে দেখার মত। মার্কসবাদে কোনো জাতীয়তাবাদের, সাম্প্রদায়িকতার স্থান নাই। ফলে সেখানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গারও কোনো স্থান নাই। সেই শ্রেণিহীণ প্রলেতারিয়েতের দুনিয়া ছাড়া এই ধর্মীয়, জাতীয় সন্ত্রাসের নামে দুনিয়া জুড়ে যেই দাঙ্গা ছড়িয়ে আছে ঘায়ের মতো তার  শেষ হবে বলে মনে হয় না কোনোদিন।

বন্দিশালা, আউৎসভিজ অথবা বস্ত্রকারখানা


পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া দেহগুলা মানুষ ছিল না কখনো, তারা ছিল শ্রমিক। তাদের শ্রম অতি সস্তা, তাদের রক্ত অতি সস্তা, অতি সস্তা তাদের ঘাম। সব মিলিয়ে তারা আসলে যন্ত্র। তারা বেঁচে থাকে পরের দিন বস্ত্রকারখানা মালিকদের হাতে যান্ত্রিক শ্রম তুলে দেয়ার জন্য। যার পারিশ্রমিক তারা কখনো পায় নাই, পাবেও না। সামান্য বেঁচে থাকার শর্তে  মালিকদের জন্য অনন্তকাল ধরে উদ্বৃত্ত পুঁজি তৈরি করার জন্যই তাদের জন্ম। তারা যে বস্ত্রকারখানা মালিকদের জন্য প্রত্যহ উদ্বৃত্ত পুঁজি তৈরি করছে তাও হয়তো তাদের অজ্ঞাত। তারা বিশ্বাস করে ইশ্বর নয় গার্মেন্ট মালিকরাই সামান্য কটা টাকা দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখে।

ফলে নিজেকে অনন্তশ্রমে রিক্ত করে কলের ভেতর নিজের জীবন সপে দেয়াই তাদের ইশ্বরের জন্য ইবাদত। শুধু নিজের শ্রম নয় তারা উৎপাদন করছে নিজেদের ঔরসে আরো আরো অনন্ত দাসের। জন্মের কিছুদিন পরই তারাও আবার শ্রমিক পিতামাতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে যাত্রা করবে শ্রমের গুহায়। এরা অশিক্ষিত। স্কুলে পড়ার সময় তাদের টান পড়ে ভাত-কাপড়ের। ফলে স্কুলের চেয়ে গুরুতর হয়ে দেখা দেয় তাদের কারখানার কাজ। কারণ কাজ না করলে ভাত বন্ধ। বেঁচে থাকা বন্ধ।

সকালে আর রাতে নগরীর কারখানা এলাকায় কেউ দাঁড়ালে দেখতে পাবে বন্দীশালার বন্দীদের মত কাতারে কাতারে তাদের যাওয়া আসা।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোল্যান্ডে আউৎসভিজ বলে একটা বন্দিশালা ছিল। যাকে বলা হতো নরক। সেখানে ছিল দানবীয় আকারের গ্যাস চুল্লি। হাজার হাজার মানুষকে যেখানে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। তাদের সেখানে গোসল করানোর নাম করে, কাপড় বদলানোর নাম করে ঢোকানো হতো। বন্দিদের পুড়িয়ে মারা হবে এটাই স্বাভাবিক। তাই বন্দীদের ভেতর বাঁচার আকুলতা বয়ে গেলেও গেস্টাপোদের তাতে কিছুই আসতো যেতো না।

অনুরূপভাবে বাংলাদেশের বস্ত্রকারখানাগুলা বিশেষ করে শ্রমিকরা যেখানে কাজ করে। সেসব অনেক আগেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আউৎসভিজে পরিণত হয়েছে তা আমরা বছরের পর বছর ধরে দেখছি। প্রায়শই শ্রমিকরা পুড়ে মরছে। আগুনে তাদের হত্যা করা হচ্ছে। যে সরকার ক্ষমতায় থাকছে। তারা সেইদিন খুব শোকের ভান করছে। আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে শোকের আর্তনাদ। আমরা প্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছি এই নিয়মে। এখন হত্যা আমাদের কাছে তেমন গুরুতর সংবাদ না।সাভারের আউৎসভিজ এই বস্ত্রকারখানায় ১৪০জন শ্রমিককে পুড়িয়ে মারার সংবাদও কিছুদিন পর আরো ফলোআপ পাবে না। আমরা আবার বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বো।

আমাদের আর মনে থাকবে না এই শ্রমিকেরা আগুন লাগার সংকেত পেয়ে নামতে চেয়েছিল। বাধা পেয়েছিলো কারখানা মালিকদের। কারখানা মালিকেরা তাদের সাথে প্রতারণা করেছিল। মিথ্যা বলে ঠেলে দিয়েছিল সোজা মৃত্যুকুপে। তারা বলেছিল আগুন লাগে নাই। ফের তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। এরও আগে উপরের দিকে যেন তারা উঠতে না পারে যেখানে আগুন পৌছে নাই সেখানে তালা লাগিয়েছিল। কারখানা মালিকরূপী জল্লাদ তথা গেস্টাপোদের এরপরও কিছু হবে না। কারণ তারাই রাষ্ট্র টিকিয়ে রেখেছে। রাষ্ট্র নির্মাণ করেছে। তাদেরই অনুগ্রহ পেয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ বসে আছেন তাদেরকে সহযোগিতা দেয়ার জন্য।

গণমানুষতো বানের পানির মতো ইচ্ছা মতো খরচ করা যায়।প্রথাগত কারখানা মালিকদের পত্রিকার কলাম লেখকরা এরপর খুব ব্যস্ত হয়ে কারখানায় কয়টা জানলা করলে শ্রমিকরা আগুন লাগলেও নিচে লাফ দিয়ে মরতে পারবে ইত্যাদি লিখতে থাকবে। কিন্তু ষ্পষ্টতই বলা যায় এইটা হত্যাকাণ্ড। আর এই যুদ্ধের নাম শ্রেণিযুদ্ধ। এইভাবে গণহারে শ্রমিকদের মৃত্যু নাজিদের উল্লাস হয়ে আসে কারখানা মালিকদের। কারণ মানুষগুলো তাদের কাছে শোষণের যন্ত্রমাত্র।

ধর্ষণ সামাজিক সমস্যা তবে পুঁজিবাদী ব্যাধি


বিশ্বনন্দিত জাপানি চিত্রপরিচালক মহাত্মা আকিরা কুরোশাওয়া তার বিখ্যাত ‘রশোমন’ চলচ্চিত্রে এমন এক বিষয়ের অবতারণা করেন। যা বহুদিন ধরে শিল্পবোদ্ধাদের মনস্তাত্বিক সমালোচনায় মুখর করে তুলেছে। ছবিতে নায়িকা জঙ্গলের ভেতর ধর্ষিতা হয়। এই ধর্ষনকে কেন্দ্র করেই পুরা ছবিটা আবর্তিত হতে থাকে। একলোক তার স্ত্রীকে ঘোড়ায় চড়িয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিয়া যাচ্ছিল। জাপানের চিরাচরিত নিয়মানুসারে লোকটার কোমরে তলোয়ারও ছিল। জঙ্গল ও পাহাড়ি আকাবাকা পথ দিয়া তাদের যাত্রা চলতেই থাকে। জঙ্গলের ভেতর গাছের গুড়িতে শুয়ে আরাম করছিল ধূর্ত ও খাপছাড়া টাইপের শ্রমিক শ্রেণির এক লোক। তাকে দেখে দম্পতি ভয় পেলেও চলতে থাকে। পাশ দিয়ে যাবার সময় লোকটা মেয়েটার সুন্দর পা জোড়া দেখে ফেলে। জঙ্গলের নি:সঙ্গতা ও চিরাচরিত আদিম বাসনা তাকে উম্মত্ত করে তোলে। সে ছলচাতুরি করে স্বামীটাকে বন্দী করে। আড়ালে নিয়া স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। মেয়েটার কোমরেও লুকানো ছুরি ছিল কিন্তু সে লোকটা ক্ষিপ্রগতির সাথে পেরে উঠলো না।

একপর্যায়ে ধর্ষন করা অবস্থায় মেয়েটার হাত থেকে ছুরিটা খসে পড়ে এবং মেয়েটা ধর্ষককে আরো কাছে টেনে নেয়। বিশেষ করে এই মন্তাজটা মানে এই বিপ্রতীপ ঘটনাটা। হাত থেকে ছুরি খসে পড়া আর ধর্ষককে আরো কাছে টেনে নেয়ার দৃশ্যটা যুগ যুগ ধরে সমালোচনা কুড়িয়েছে। কিন্তু ট্রাজেড়ির কেবলি শুরু। ধর্ষণ করে ধর্ষক চলে যাবার সময় মেয়েটা বাধা দিয়া বলে, যে কোন একজনের সাথেই কেবল আমি যেতে পারি। হয় তুমি বেঁচে থাকবে না হয় আমার স্বামী। এই প্রশ্নের ভেতর আটকে যায় ধর্ষক।

যাইহোক সম্প্রতি ধর্ষন নিয়া দক্ষিণ এশিয়া বেশ কয়েকবার ধাক্কা খেল। ভারতে বাসের ভেতর বেশকয়েকটি গণধর্ষনের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশেও একটার পর একটা ধর্ষনের ঘটনা ঘটতে থাকে। ধর্ষন মূলত পুরুষতান্ত্রিক শক্তির মহড়া ও প্রয়োগ। একটা ড্রাইভারও তার গৃহকর্ত্রীকে ধর্ষনের বাসনা পোষণ করে। যেমন একটা রিক্সাওয়ালা তার আরোহী মহিলাকে। তার নিজের অজান্তেই এই বোধ সে যুগ যুগ ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে যে, যে কোনো শ্রেণির নারীই হোক, কর্তৃত্ব পুরুষের। নারী পুরুষের কাছে এক দুর্বল প্রাণিমাত্র। যাকে ভোগ করা যায়, যার উপর কর্তৃত্ব করা যায়, যার সাথে প্রতারণা করা যায় তবুও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষের পক্ষেই রায় দেবে। এই জন্য এই সমাজে ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে দেয়া হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্ট্রাকচারের মধ্যেই এই বাসনার বীজ নিহিত।

রশোমন সিনেমাতেও তাই দেখা যায়। একপুরুষের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে মহিলাকে অন্য পুরুষ ধর্ষন করে। এইখানে মহিলা একটা খেলা খেলেছিলেন পুরুষতান্ত্রিক পাষবিকতার দিকেই ঠেলে দিয়েছিলেন দুইপুরুষকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বিকল্প চয়েস থাকেনা মেয়েদের। বাসে যে মেয়েটি গণধর্ষিত হয়েছে তার কাছে কোনো বিকল্প চয়েস ছিলনা। তাকে বাধ্য হয়েই পুরুষতন্ত্রের এই নির্মম প্রহার সহ্য করতে হয়েছে। এইখানে মেয়েটার আত্মহত্যা অথবা হত্যা সমান। সে বেঁচে থাকলেও সমাজ তাকে অগণিতবার হত্যা করবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষকেরাই হত্যা করে ধর্ষিতাকে। 

নারীর কাছ থেকে জোর করে এই সম্মতি আদায় পুরুষ তখন থেকেই করে আসছিল যখন পুরুষ অর্থ উপার্জনের অনেক পথ পেয়ে গেছে। আর নারী সন্তানাদি উৎপাদন ও লালনপালনের ভার নিয়ে নিজেকে গৃহে অন্তরীণ করেছে। ইউরোপে আমেরিকায় নারীরা এখন অনেক বেশি কর্মমূখী, অনেক বেশি ঘরহীণ। কিন্ত তাতে তাদের কর্তৃত্ব খানিকটা বাড়লেও পুরুষতান্ত্রিক চিরাচরিত ধারণার গুহ্যবাসনা থেকে তারা মুক্তি পায় নাই। ইউরোপ আমেরিকায় ধর্ষনের হার আতংকিত হবার মতই।

এর কারণ কি? আমি বলবো পুঁজিবাদ। অনেকেই দ্বিমত করবেন জেনেই বলছি। যেহেতু নারীর ভেতর যথেষ্ট যৌন উপাদান আছে। আর যৌন উপাদান যেহেতু প্রাণিমাত্রেরই মূল চাহিদা। সেহেতু খুব দ্রুত যে তা পণ্য হয়ে উঠবে তা বলতে অর্থনীতির জ্ঞান প্রয়োজন নাই। পুঁজিবাদের চোখে নারী সম্পূর্ণ পণ্য। ঢাকা শহরে যেকোনো মেট্রেসের বিজ্ঞাপনে দেখবেন ভাঁজ করে রাখা ফোমের সামনে এক নারী মডেল কামনামদির চোখ নিয়া বসে আছে। এই বিজ্ঞাপনটা আমাদের কি বলতে চায়? এই বিজ্ঞাপনটা আমাদের বলছে এই ফোমে এইধরণের নারী সঙ্গম উপাদেয়। শুধু ফোমে কেন এমন কোনো পণ্য নাই যার সাথে নারীকে ব্যবহার করা হয় না। ফলে ঠিক পণ্যটি মতই আরেকটা পণ্য হিসাবে আমরা নিজের অজান্তেই নারীকে নিচ্ছি। আর মডেলিং যেহেতু বেশ আয়কর পেশা হিসাবে দাঁড়িয়েছে সুতরাং নারীরাও যে সেদিকেই ঝুকবে তাতে সন্দেহ কি?শুধু কি মডেলিং! হলিউড, বলিউড থেকে শুরু করে দুনিয়ার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের একটা বৃহদাংশই হচ্ছে আসলে পর্ণ ছবির কারবার।

বম্বের প্রায় সিনেমা আসলে পর্ণ সিনেমা। সিনেমার অর্ধেক পুরুষ নায়কটার মারামারি, খুবজখম, চুরি ডাকাতি আর নায়িকাটার আকর্ষণীয় দেহ প্রদর্শন। অর্থাৎ বর্তমান বাণিজ্যিক সিনেমা আমাদের বলছে যে কোনো উপায়ে পয়সা কামাও আর নারী ভোগ কর। নারীদের প্রতি ম্যাসেজ তোমরা নিজেদের দেহকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তোলো। সেই জন্য আছে হরেকরকম প্রসাধনী। অর্থাৎ দুইটা পেশা এখন সেরা পেশাদার খুনী আর উচ্চাভিলাষি বেশ্যা। শুধু এখানেই স্থীর নাই এই বাণিজ্যিক পরিকল্পনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা উন্নত দেশে গড়ে উঠছে এইচডি পর্ণগ্রাফির ইন্ডাস্ট্রি। ইন্টারনেট ভরে যাচ্ছে সেই সব পর্ণগ্রাফিতে। কি নাই সেখানে! যারা ইন্টারনেটে এসবের খোঁজ রাখেন তারা জানেন, কত হরেকরকম সেসব ওয়েবসাইট। মানুষের সমস্ত নৈতিকতাকে সেখানে নস্যাৎ করা হয়েছে। জবাই করা হয়েছে নীতিবোধকে। মার সাথে ছেলের যৌনতা, বাবার সাথে মেয়ের, দাদির সাথে নাতির, শিক্ষিকার সাথে ছাত্রের, শিক্ষকের সাথে ছাত্রীর,  ছেলের বন্ধুর সাথে মায়ের, ভাইয়ের সাথে বোনের, হাসপাতালের নার্সের সাথে রোগীর, ডাক্তারের সাথে রোগীনির, অফিসের বসের সাথে চাকুরীজীবীর, নানের সাথে পাদ্রির মোটকথা এমন কোনো চরিত্র নাই যাকে এসবের মাধ্যমে কলুষিত করা হচ্ছে না। আর এসব এইচডি পর্ণগ্রাফি পুঁজিবাদের অন্যতম হাতিয়ার বিজ্ঞানের বদৌলতে এত বেশি সহজলভ্য যে, যে কারো মোবাইল ফোনের ভেতর এখন এসবের অবস্থান। নারীর মানুষ হয়ে উঠার সমূহ সম্ভাবনাকেই বিনাশ করেছে এই পর্ণগ্রাফিক সাইটগুলা।সন্দেহ নাই ধর্ষণ অবদমিত যৌন উত্তেজনার আকস্মিক বহি:প্রকাশ।

এই মোবাইল স্ক্রীনে পর্ণছবির কারণে নিরন্তর যৌন উত্তেজনায় ভুগছে ছাত্র, বাস ড্রাইভার থেকে শুরু করে যারা এসবরে ব্যবহার করছেন। ফলে একলা নারীর চলাফেরা যে একেবারেই অসম্ভব হয়ে উঠতে যাচ্ছে তাতে সন্দেহ কি। যে কোন বয়সের নারীকেই ভোগের মাল হিসাবে গণ্য করবার সম্ভাবনার দ্বারে এসে পৌছেছে পর্ণগ্রাফিগুলা। সবকিছু মিলিয়ে এই পর্ণগ্রাফিক ইন্ডাস্ট্রি ফটকা ব্যবসায়ের মতো। সমাজের লাভ ক্ষতি নিয়া তোড়াই কেয়ার তাদের। তাদের দরকার মুনাফা। যতবেশি ডাউনলোড ততবেশি পয়সা। ফলে অসাধারণ সুন্দরীরা সব এখন পর্ণস্টার। পর্ণস্টাররা তারকা হিসাবে উন্নত বিশ্বে যথেষ্ট সম্মান পাচ্ছেন। তার উপর বম্বেতেও পর্ণস্টারদের নিয়া সিনেমা তৈরি শুরু হয়েছে। আর সেই বম্বের সিনেমায় ছয়লাব দক্ষিণ এশিয়া। এই চক্রের ভেতর আবর্তিত হচ্ছে আমাদের দুনিয়া। পুঁজিবাদের পতনের আগে এই পুঁজিবাদি ব্যাধির অবসান কল্পনা মাত্রই মনে হয়। বরং ধর্ষন মহামারি আকারেই ছড়াবে বিশ্বময়। ফলে সামাজিক সমস্যা হিসাবে ধর্ষন নিরন্তর বাড়বে বৈ কমবে বলে মনে হয় না।

হিন্দু মুসলমান সম্পর্ক ও পরাজিত পাকিস্তানের প্রেতাত্মা


ইসলামে পরধর্মকে আমানত বলা হয়। বিদায় হজের ভাষণেও একটা পয়েন্ট আছে যেখানে বলা হচ্ছে বিধর্মীরা ইসলামি রাষ্ট্রের আমানত। তাদের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব মুসলমানের। হাদিসেও বর্ণিত আছে মুহাম্মদ (সা:) প্রতিদিন খাওয়ার সময় একেকজন অথিতি সঙ্গে নিতেন। একদা তিনি একজন অচেনা পথিককে পেলেন সঙ্গী হিসাবে। খেতে বসে এই অচেনা পথিক বিছমিল্লাহ বলেন নাই। তিনি খানিক রুষ্ট হলেন বটে কিন্তু তা প্রকাশ করলেন না। বুঝলেন এই অথিতি মুসলমান নন। অই সময়ই তার উপর আয়াত নাযিল হয় দুনিয়ায় বিচরিত সমস্ত প্রাণিকুলের রিজিক মহাপ্রভুর হাতে। যিনি খাওয়াচ্ছেন তিনি উপলক্ষমাত্র। কারণ সবসৃষ্টিরই সৃষ্টিকর্তা ও ত্রাণকর্তা আল্লাহ। ইসলামি রাষ্ট্রে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অধিকার নিয়া ইসলামি গ্রন্থসমূহে আরো অনেক বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে।

কিন্তু সবসময় জামাতশিবিরের কাছে প্রথম আক্রমণের বিষয় হিসাবে এইদেশে দেখা গেছে সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়। এরও একটা শানেনুযুল আছে। পাকিস্তান আর ভারতের যেই সাম্প্রদায়িক বিভাজন। দেশভাগের পেছনের কারণ নিয়া এখনো অনেক গবেষণা হচ্ছে। সেইসব কারণ ব্যাখ্যা করলে ধর্মভিত্তিক দেশভাগের জন্য সেসময়ের ভারতে হিন্দু বুর্জোয়ারাও কম দায়ি নয়। ভারতের উগ্র হিন্দু আর পাকিস্তান বাংলাদেশের জামাতের মধ্যে খুব একটা ফারাক নাই। যাইহোক পাকিস্তানিরা ভারতিয়দেরকে ’হিন্দু’ বা ভারতিয়রা পাকিস্তানিদেরকে ’মুসলমান’ হিসাবে ট্রিট করে। দেশভাগের ও ছোটখাট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর এই শব্দদুটি আর আগের অর্থ বহন করেনা।

কিন্তু বাংলাদেশের রাষ্ট্র হিসাবে জন্ম নেয়ার সম্ভাবনার পেছনে অর্থনীতিতো বটেই বাংলাভাষা তথা বাঙালি সাংস্কৃতিক, জাতীয় ঐক্যর বিশাল অবদান ছিল। যেজন্য একই ধর্মানুসারী হওয়া স্বত্তেও পাকিস্তান এক থাকতে পারে নাই। অন্যদিকে একাত্তরে জামাতের ভূমিকা সম্পর্কে এখন সবাই ওয়াকিবহাল। জামাত যেহেতু পাকিস্তানের অন্ধঅনুসারী ও তাবেদার। সেই হিসাবে তারা একাত্তরেই টার্গেট করেছিল হিন্দুদের। রাজাকারদের প্রধান কাজই ছিল হিন্দু নারীদের ধরে পাকিস্তানি আর্মির কাছে নিয়ে আসা। হিন্দুদের ঘরবাড়ি মন্দির জ্বালিয়ে দেয়া। হিন্দুদেরতো বটেই অনেক মুসলমানকেও তারা লুঙ্গি ইত্যাদি খুলে দেখেছে, খৎনা আছে কিনা। শুধু হিন্দুদের নয় যারাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলেছে বিশেষ করে বুদ্ধিজীবী সমাজ। তাদেরকেও খতম করার দায়িত্ব অথবা নিদেন পক্ষে তাদেরকে চিহিৃত করে দেয়ার দায়িত্ব ছিল তাদের।

এই ভুখণ্ডকে কেন্দ্র করে এইটা ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বললেও অত্যুক্তি হয় না। কারণ পাকিস্তানকে দুইভাগ করে ফেলতে পারলে ভারতের সামনে বিভক্ত পাকিস্তান আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেনা। ভারত দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ দ্বারা সরাসরি শাষিত হওয়া ও ভারতের কেরাণি সমাজ যারা শেষের দিকে ব্রিটিশতন্ত্রের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। তারা দীর্ঘ পরিসরে বিষয়টা চিন্তা করতে বাধ্য ছিল। অন্যদিকে ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে এদেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে অভিভক্ত ভারতিয় সংস্কৃতির বাহক। এদেশের মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ফলে আমাদের সংস্কৃতিক মানসও পাকিস্তানের জন্য অস্বস্থির ও অস্থিরতার ব্যাপার ছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যার প্রমাণ।
এদেশের মানুষ ধর্মের খাতিরেও ধর্মীয় ভাষাকে নেয় নাই। অসাম্প্রদায়িকতার এরচে বড় উদাহরণ কী হতে পাওে আর?

অন্যদিকে পাকিস্তানে লুম্পেন সামরিক রাজনীতিকরা মননে ও চালচলনে পশ্চিমমুখি ভোগি হওয়া স্বত্বেও। সাধারণ মানুষের তথা অবুঝের ধর্মটাকেই পুঁজি করে। তারা সরাসরি ধর্মান্ধ মুসলমান সমাজকে কলুষিত করে সাম্প্রদায়িক বিষে। এবং নানা প্রপাগাণ্ডায় তারা এই বিষ ছড়াতে থাকে। যার সাথে ধর্মীয় চেতনার কোনো সম্পর্ক নাই। যেমন এখনো ছড়ানো হয়েছে সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে। যারা ছড়িয়েছে তারা জানে এটা মিথ্যা। কিন্তু তাঁরা ধর্মীয় অন্ধ আবেগকে জাগিয়ে তোলে গণহারে মুসলমানদেরকে বন্ধুকের সামনে বিছিয়ে সাঈদী তথা যুদ্ধাপরাধীদের মুক্ত করার রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের পরিকল্পনা করেছে। অথচ ধর্মের নামে জামাতের মিথ্যাচার যদি কোনো প্রকারে একবার সাধারণ মুসলমান সমাজ ধরতে পারে তাহলে তাদের হাত থেকেই জামাতের রক্ষা পাওয়া দুষ্কর হবে। 

ধর্ম নিয়া এই মিথ্যাচার আজকের নয় এর খানিক ইতিহাস আছে। ১৯৫০ সালে পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি রুখতে মার্কিন স্ট্যাট ডিপারর্টমেন্ট এক প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছিল। যেই ডকুমেন্ট সম্প্রতি অনলাইনে ওপেন করে দেয়া হয়েছে। ডকুমেন্টের অনেকগুলা পয়েন্টের মধ্যে একটা পয়েন্ট ছিল যে সমস্ত মৌলানা ওয়াজ মাহফিল করছে তাদেরকে অর্থ ও নানান ধরণের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আরো বেশি তৎপর করে তোলা। যেন তারা সবখানে ওয়াজের সময় সুক্ষভাবে কমিউনিস্ট বিরোধী প্রচারণা চালাতে পারে। এবং তার ফলও হয়েছে। এখনো গ্রামে গঞ্চের মানুষ ধর্ম বিষয়ে কিছু না বুঝলেও কমিউনিস্ট মানে বুঝে। তাদের কাছে কমিউনিস্ট মানে কাফের, ইসলামের শত্রু। এই সাঈদীরা আরো একধাপ এগিয়ে ছিল তারা প্রচারণা করেছে আওয়ামীলীগ হচ্ছে হিন্দুদের দল, আওয়ামীলীগ ধর্ম মানেনা ইত্যাদি। এইসব ব্যবহার করে দ্রুত তারা জাতিকে দুইভাগে ভাগ করতে সমর্থ হয়।

এখনো বিদেশি মিডিয়া সাঈদীদের ঘাতক, যুদ্ধাপরাধীর বদলে ইসলামী নেতা বলা হয় পশ্চিমি মিডিয়া সেই পুরানা ষড়যন্ত্রই পাকিয়ে তোলে। শুধু মৌলানাদের নয় আজকের যেই ফরহাদ মজহার তাদেরও চিন্তাকে বিভ্রান্ত করার জন্য এনজিওর মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে অর্থ দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্টসহ বিশ্বব্যাংক আইডিবি ইত্যাদি পুঁজিবাদি সংস্থা। এনজিওর জন্মদাতা ছিলেন তৎকালীন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা। তিনি এই পলিসি নিয়েছিলেন ভিয়েতনামে সরাসরি যুদ্ধে মার্কিন পরাজয়ের পর। এটা হচ্ছে তৃতিয় বিশ্বে সাথে পুঁজিবাদের ঠাণ্ডা যুদ্ধ। সরাসরি যুদ্ধে শোষিতদের হারিয়ে দেয়ার চাইতে মননে তাদের আরো পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়া।

আজকে যাদেরকে নাইট উপাধি দেয়া হচ্ছে, ম্যাগসেসাই, নভেল দেয়া হচ্ছে সেসব সুশীলদেরও কাজ তাই।এরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। কেউ অর্থনৈতিক ঘাতক, কেউ সাংস্কৃতিক ঘাতক, কেউ সামাজিক ঘাতক। সবার লক্ষ্যই অভিন্ন এদেশে সাধারণ মানুষকে চিন্তায়, অর্থে, সামাজিকতায় সংঘবদ্ধ হতে না দেয়া। এবং বিভ্রান্তি ও সামাজিক নৈরাজ্য জিইয়ে রাখা। সোজা কথা চিন্তায় মানুষকে ঘুম পাড়ানো নাইলে বিভ্রান্ত করা। এক্ষেত্রে ফরহাদ মজহার ও সাঈদীর কাজ মূলত একই। তাই সাঈদীকে রক্ষা করা ফরহাদ মজহারের অর্থনৈতিক দায়িত্ব।

সাঈদীর ফাঁসির সাথে হিন্দুদের কি সম্পর্ক? আপাত চোখে দেখা না গেলেও অদৃশ্য সম্পর্কতো আছেই। ভারত আর পাকিস্তানের ভেতর যেই সম্পর্ক সাঈদীর ফাঁসির সাথে হিন্দুদের সেই সম্পর্ক জামাতিদের অদৃশ্য মননে। এক্ষেত্রে বলা যায় জামাতিরা যদি সত্যিকার অর্থে মুসলমান হতো তাহলে তারাতো ধর্মমতেই চলতো। অন্য ধর্মের মানুষেরা তাদের কাছে আমানত হিসাবে গণ্য হতো। তাহলে এই শত্রুতা কোথা থেকে আসে। মূলত একাত্তরের পরাজিত শত্রু হিসাবে জামাতে ইসলাম সেই পরাজয় মেনে নিতে পারে নাই। জামাতশিবির মূলত পাকিস্তানের প্রেতাত্মা হিসাবেই বিচরণ করছে এই দেশে। পরাজয়ের প্রতিশোধ নিয়া আবার এইদেশকে পাকিস্তান বা বাংলাস্থান বানানোর জন্য তারা বদ্ধপরিকর। জামাত ইসলামের ধোয়া তুলে মূলত সেই পরাজয়ের প্রতিশোধই তারা নিতে চায়।

এক্ষেত্রে এসে গত চল্লিশ বছরে শেখ মুজিবসহ সব শাসককেই কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হয়।সাঈদীর ফাঁসির সাথে হিন্দুদের কোনো কারণ না থাকা স্বত্বেও হিন্দুদের মন্দির বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে জামাতশিবির যে আক্রমণ করছে এখনো তারা মনে করছে তারা পাকিস্তানি। যাদের জন্মশত্রু ভারতিয় তথা হিন্দুরা। তারা ভাবছে হিন্দুরা ভারতিয় তাদের বাংলাদেশে থাকার অধিকার নাই। তারা এখনো মননে পাকিস্তানকে কত গভীরভাবে লালন করে এটাই তার প্রমাণ। তাই ইসলাম আর জামাতে ইসলাম এক জিনিস নয়। তারা ইসলাম ব্যবহার করে ফায়দা উসুলকারী। তারা মূলত একাত্তরপূর্ব পাকিস্তানের প্রেতাত্মা।

চেতনান্ধ ফরহাদ মজহারের তালগাছ ও দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ


ফরহাদ মজহার স্বসম্পাদিত অনলাইন পত্রিকা 'চিন্তা'য় ‘হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করুন’ শিরোনামে একটা নিবন্ধ লিখেছেন। যা ফেসবুকের কল্যাণে অনেকের গোচরিভূত হয়েছে। ফরহাদ মজহারের এই নিবন্ধটি নানা কারণে গুরুত্ববহ, বিশেষ করে চিন্তা সরবরাহকারী বা চিন্তাবিক্রেতা হিসাবে তার অবস্থান ষ্পষ্ট করে আমাদের কাছে, আমরা যারা তার লেখা পাঠ করি। পুরা লেখাটা যুক্তিপূর্ণ চালাকিতে ভরা। যেন তিনি নিজের চেতনার দরজা জানলা বন্ধ রেখে এই লেখা লিখেছেন। কারণ তিনি শুধু নিজের তাল গাছটা চাইছেন। আর তাই ন্যায়ে'র সংজ্ঞাকে বিকৃত করেছেন ইচ্ছেমতো।

তার নিবন্ধের শুরুটা এরকম ‘ দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে পুলিশ যেভাবে মানুষ হত্যা করেছে তাকে নির্বিচার গণহত্যা ছাড়া মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের দিক থেকে আর কিছুই বলা যায় না।’
এই লাইনটা যে কেউ পড়লেই বুঝতে পারবেন লেখাটা সম্পূর্ণ স্বার্থান্ধ। বাংলাভাষা যারা শুনে বুঝতে বা পড়তে পারেন। প্রায় একমাস ধরে বাংলাদেশে যা হচ্ছে তারা তা অবগত আছেন। তারা লাইনটা এভাবে পড়তে চাইবেন। একাত্তরের পিচাশ, ধর্ষক, নরঘাতক, দেল্যা রাজাকারের ফাঁসির রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সারাদেশে জামাত শিবির তাণ্ডব ও ধ্বংশযজ্ঞ শুরু করে, তা প্রতিরোধ করতে গিয়ে তারা মুহুর্মুহু পুলিশসহ সাধারণ জনগণকে আতংকিত করে তোলে। পুলিশের সাথে সরাসরি যুদ্ধ বাধায়। এই যুদ্ধে পুলিশ, পথচারী, শিবির সহ অনেকেই নিহত হয়েছেন।

তাইলে দেখা যাচ্ছে ফরহাদ মজহার কার্যকারণ সম্মন্ধটাকেই সরিয়ে দিয়েছেন।  যে কোনো মস্তিষ্কবিকৃতিহীন মানুষই প্রশ্ন করবে দেলোয়ারের রায় শুনে পুলিশ কেন মানুষ হত্যা শুরু করবে?  আর এই তৃমুখি লড়াইকে তিনি আখ্যায়িত করছেন ‘নির্বিচার গণহত্যা’ ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন’। তাহলে এইখানে প্রশ্ন হয়া দাঁড়ায় ‘বিচার’ আর ‘মানবাধিকার’ বলতে তিনি কি জ্ঞান করেন? 

এই নিবন্ধেই তিনি বলছেন ‘পাবলিক লিঞ্চিং যেমন হতে পারে না, তেমনি যারা রায়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে তাদের নির্বিচার গুলি করাও আমরা সমর্থন করতে পারি না।’
১৯৭১ সালের ৩০ লাখ মানুষের হত্যাকারীদের বিচার দাবি তার কাছে বিচার না নির্বিচার? ২ লক্ষ নিরীহ মহিলার সম্ভ্রমহানির বিচার দাবি তার কাছে বিচার না নির্বিচার? যেই তরুণ সমাজ লক্ষ লক্ষ মানুষের হত্যার বিচার দাবি করছে, লক্ষ লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হারানো অমীমাংসিত বিচার দাবি করছে তাকে তিনি বলছেন ‘পাবলিক লিঞ্চিং’!!

তিনি সেই দাবিকে যে শুধু পাবলিক লিঞ্চিং বলেই তার উকালতি শেষ করছেন তা না, লগে রায়ে বিক্ষুব্ধ হয়ে যারা দেশটাকে আবার পাকিস্তান বানাবার কোশেশ করছেন, দেশটাকে একটা গৃহযুদ্ধের দিকে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন তাদের প্রতিরোধও সমর্থন করছেন না।এইখানে এসে তিনি যেন অস্তিত্ববাদী হয়ে উঠতেছেন। যেন তিনি এড়িয়ে যেতে চাইছেন রাষ্ট্র ও সংবিধানের দোহাই দিয়ে খোদ ইতিহাসকেই।  যেন অবজ্ঞা করছেন একটা রাষ্ট্র অর্জনের পেছনে আত্মত্যাগকেই। সেই রাষ্ট্রের আইনেই তিনি বাঁচানোর জন্য উকালতি শুরু করেছেন সেই রাষ্ট্রের জন্মের বিরোধীতাকারীদের। হায় ধর্ষক ও খুনীদের উকিল ফরহাদ মজহার।


তিনি নিবন্ধে আরো লিখেছেন ‘এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের প্রাথমিক পদক্ষেপ হতে পারে অবিলম্বে পুলিশী বর্বরতা ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা। দ্বিতীয়ত, বিক্ষোভ  সহিংস হলেও অবিলম্বে তার কারন অনুসন্ধান করা।’ লক্ষ্যণীয় তিনি যে সমস্ত শব্দাবলি ব্যবহার করছেন। সে সবের দ্বারা বাক্যটা কেমন ম্যাজিক সৃষ্টি করতেছে দেখেন।পুলিশের দায়িত্বকে তিনি নিয়ে যাচ্ছেন বর্বরতার কাতারে, হত্যাযজ্ঞের কাতারে। আবার বলছেন বিক্ষোভ সহিংস হলেও যেন পুলিশ চুপ করে থাকে। এর মানে কি খুলে বলতে হবে প্রিয় পাঠক? তিনি জাতিকে এই পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারের পথ বাতলাচ্ছেন পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা ও জামাত শিবির হত্যা করলেও, রেল লাইন উপড়ে ফেললেও, অজস্র মন্দির আর রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দিলেও কি কারণে করছে তা অনুসন্ধান করা । দেল্যা রাজাকারের ফাঁসির আদেশ পুণ:বিচার করে বেকসুর খালাস করে দেয়া। বোকার স্বর্গে ঠিক কে বাস করে ফরহাদ না এদেশের জনগণ তা জানিনা। কিন্তু ফরহাদ যে চিন্তাপাপি সেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে উঠে।

পুরা লেখাটা পড়ে মনে হতে পারে তিনি যা বলতে চাইতেছেন তার আগাও নাই মাথাও নাই। তিনি কি ভুলে গেছেন বিচ্ছিন্নভাবে সাঈদীদের ফাঁসিকে দেখবার অবকাশ নাই? আজকের যুদ্ধাপরাধী যাদের বিচার করা হচ্ছে বা হবে তাদের বিচার করতে হলে আমাদেরতো ৪০ বছর আগে ফিরতেই হবে। যদি বলি চল্লিশ বছর আগে কি হয়েছে তা নিয়া মাথা ঘামানোর দরকার নাই। তাইলে গত চল্লিশ বছর ধরে যেই নরকের ভেতর বাস করতেছে এই দেশ সেই নরকবাস আরো প্রলম্বিত হবে। যদিও মহাত্মা আহমদ ছফা বলেছিলেন 'আওয়ামীলীগ হারলে সবাইকে নিয়া হারে, জিতলে একাই জিতে'। কিন্তু এইবার আওয়ামীলীগের একা জিতার আর অবকাশ নাই।

ফরহাদ বলছেন ‘মনে রাখতে হবে পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে সন্ত্রাসী ভূমিকায় নামলে ধীরে ধীরে তার বিরুদ্ধে পালটা বলপ্রয়োগের পক্ষে জনমত তৈরী হয়।’ গত চল্লিশ বছর ধরে এদেশের পুলিশ যেই বদনাম কুড়িয়েছে তার যেন প্রায়শ্চিত্ত করছে তারা এখন। পুলিশের ভেতর যদিও এখনো অনেক জামাত-বিএনপির রিক্রুট করা নিষ্ক্রিয় পুলিশ রয়ে গেছে। তিনি আরো বলেন ‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান চরিত্র লক্ষণ হচ্ছে রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিকের নাগরিক ও মানবিক অধিকার যে কোন মূল্যে রক্ষা করে।’ খেয়াল করেন তিনি এখানে ইতিহাসের পুরাটাই গাপ করে দিয়ে রাজাকারদের নাগরিক হিসাবে টিকিট দিচ্ছেন। এবং তাদের টেনে নিয়ে আসতেছেন তথাকথিত মানবিকতার কাতারে। এর মানে হচ্ছে ধর্ষিতা ধর্ষককে রক্ষার জন্য সম্ভ্রমের লগে তার অস্তিত্বও বিপন্ন করবে। যে ভুখণ্ড এখনো কোনো রাষ্ট্রেই পরিণত হতে পারে নাই তার কাছে তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রবাসনা বাতুলতার শামিল। এই স্ট্রাগলও একটি রাষ্ট্র হয়ে উঠবার স্ট্রাগল ছাড়া অন্য কিছু না।

আগে ভাবতাম ফরহাদ মজহার আওয়ামীলীগ বিরোধীতা করেন। অনেক বাম পণ্ডিতও তা করেন। নিজেও বলি আওয়ামীলীগ বিরোধীতা আর একাত্তরের বিরোধীতা এক জিনিস না। আওয়ামীলীগ যেকোনো কারণেই একাত্তর বান্ধব হলেও একাত্তরের সবটুকু অর্জন এদেশে গণমানুষের। তিরিশ লাখ শহিদের দুইলাখ সম্ভ্রমহারা নারীর। সেই মানুষকেই হত্যা করতে ধর্ষণ করতে সহযোগিতা করেছিল এই রাজাকার বাহিনী যাদের পক্ষে আজ ফরহাদ মজহারের অবস্থান? সেই শহিদ ও সম্ভ্রমহারা নারীদের বিরুদ্ধেই ফরহাদের অবস্থান?

ইতিহাস সাক্ষী এই ঘটনা অনিবার্য ছিল। চল্লিশ বছর অনেক সময়, মীমাংসার ব্যাপারে। এরতো একটা ফয়সালা হবেই। কারণ ধর্ষক আর ধর্ষিতা একঘরে বাস করতে পারেনা, খুনি আর মৃতদেহ একঘরে বাস করতে পারে না। এটা গণহত্যা নয়, মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় সেই অর্থে যুদ্ধই। তিরিশ লাখ শহিদ হয়েছিল সেই যুদ্ধে তখন অনেক অপ্রশিক্ষিত ছিল এইজাতি। তারা এখন অনেক শিক্ষিত যুদ্ধের ব্যাপারে, নিজেদের একটা রাষ্ট্র তৈরির পক্ষে। তিরিশ লাখের প্রতিশোধের ব্যাপারেও।

সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া ঘটনার ভেতর জামাতশিবিরের যেই নৈরাজ্য কায়েমের চেষ্টা তা তার চেতনান্ধ চোখে যে ধরা পড়বে না সেতো জানা কথাই। সারাদেশে সংখ্যালঘুদের মন্দির ঘরবাড়ি দোকানপাটে আগুন ও ভাঙ্চুর তার চোখে পড়বে না। মুক্তচিন্তার প্রজন্ম প্রতিনিধি রাজিবসহ অন্যান্যদের হত্যাকাণ্ড তার চোখে অপরাধ হতে পারে না কারণ তিনি চেতনান্ধ। এই প্রজন্ম চত্বর এমনই পুলসেরাত সবার চেহারা এখানে আয়নার মতো ষ্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ফরহাদ মজহার এদেশের গণমানুষের স্বাধীনতার লগে বেঈমানী করেছেন। লাখ লাখ শহিদের রক্তের লগে বেঈমানী করেছেন। তার অবস্থান  ষ্পষ্ট। তিনি পরিণত হয়েছেন জামাতিদের পেশাদার প্রপাগাণ্ডিস্টে। নিরন্তর এইসব প্রপাগাণ্ডা গেয়ে যাচ্ছেন তিনি নয়া দিগন্ত, আমার দেশ সহ জামাতি টয়লেট্ টিসুগুলাতে। 

ফরহাদ শেষ করেন এই প্রশ্ন রেখে 'এর জন্যই কি এই দেশ স্বাধীন হয়েছিল? তাহলে কি আপনার ধারণা, এদেশ স্বাধীন হয়েছিল পাকিস্তানের দালাল ঘাতক, গণমানুষের শত্রু। লক্ষ লক্ষ মানুষের খুনিদের গাড়িতে নিরাপদে পতাকা উড়ানোর জন্য? গায়ের জোরে ইতিহাস বিকৃতি আর অবজ্ঞার একটা সীমা আছে।  কে বলেছে আপনাকে এইদেশ স্বাধীন হয়েছে? স্বাধীনতার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি আর জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ ও তারপর গণমানুষের থাকার, খাবার, চিকিৎসা ও শিক্ষার অধিকার আদায়ের পর আমরা বলবো এদেশ স্বাধীন হয়েছে।
ফরহাদ মজহার