Thursday, April 11, 2013

ধর্ষণ সামাজিক সমস্যা তবে পুঁজিবাদী ব্যাধি


বিশ্বনন্দিত জাপানি চিত্রপরিচালক মহাত্মা আকিরা কুরোশাওয়া তার বিখ্যাত ‘রশোমন’ চলচ্চিত্রে এমন এক বিষয়ের অবতারণা করেন। যা বহুদিন ধরে শিল্পবোদ্ধাদের মনস্তাত্বিক সমালোচনায় মুখর করে তুলেছে। ছবিতে নায়িকা জঙ্গলের ভেতর ধর্ষিতা হয়। এই ধর্ষনকে কেন্দ্র করেই পুরা ছবিটা আবর্তিত হতে থাকে। একলোক তার স্ত্রীকে ঘোড়ায় চড়িয়ে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে নিয়া যাচ্ছিল। জাপানের চিরাচরিত নিয়মানুসারে লোকটার কোমরে তলোয়ারও ছিল। জঙ্গল ও পাহাড়ি আকাবাকা পথ দিয়া তাদের যাত্রা চলতেই থাকে। জঙ্গলের ভেতর গাছের গুড়িতে শুয়ে আরাম করছিল ধূর্ত ও খাপছাড়া টাইপের শ্রমিক শ্রেণির এক লোক। তাকে দেখে দম্পতি ভয় পেলেও চলতে থাকে। পাশ দিয়ে যাবার সময় লোকটা মেয়েটার সুন্দর পা জোড়া দেখে ফেলে। জঙ্গলের নি:সঙ্গতা ও চিরাচরিত আদিম বাসনা তাকে উম্মত্ত করে তোলে। সে ছলচাতুরি করে স্বামীটাকে বন্দী করে। আড়ালে নিয়া স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। মেয়েটার কোমরেও লুকানো ছুরি ছিল কিন্তু সে লোকটা ক্ষিপ্রগতির সাথে পেরে উঠলো না।

একপর্যায়ে ধর্ষন করা অবস্থায় মেয়েটার হাত থেকে ছুরিটা খসে পড়ে এবং মেয়েটা ধর্ষককে আরো কাছে টেনে নেয়। বিশেষ করে এই মন্তাজটা মানে এই বিপ্রতীপ ঘটনাটা। হাত থেকে ছুরি খসে পড়া আর ধর্ষককে আরো কাছে টেনে নেয়ার দৃশ্যটা যুগ যুগ ধরে সমালোচনা কুড়িয়েছে। কিন্তু ট্রাজেড়ির কেবলি শুরু। ধর্ষণ করে ধর্ষক চলে যাবার সময় মেয়েটা বাধা দিয়া বলে, যে কোন একজনের সাথেই কেবল আমি যেতে পারি। হয় তুমি বেঁচে থাকবে না হয় আমার স্বামী। এই প্রশ্নের ভেতর আটকে যায় ধর্ষক।

যাইহোক সম্প্রতি ধর্ষন নিয়া দক্ষিণ এশিয়া বেশ কয়েকবার ধাক্কা খেল। ভারতে বাসের ভেতর বেশকয়েকটি গণধর্ষনের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশেও একটার পর একটা ধর্ষনের ঘটনা ঘটতে থাকে। ধর্ষন মূলত পুরুষতান্ত্রিক শক্তির মহড়া ও প্রয়োগ। একটা ড্রাইভারও তার গৃহকর্ত্রীকে ধর্ষনের বাসনা পোষণ করে। যেমন একটা রিক্সাওয়ালা তার আরোহী মহিলাকে। তার নিজের অজান্তেই এই বোধ সে যুগ যুগ ধরে বয়ে বেড়াচ্ছে যে, যে কোনো শ্রেণির নারীই হোক, কর্তৃত্ব পুরুষের। নারী পুরুষের কাছে এক দুর্বল প্রাণিমাত্র। যাকে ভোগ করা যায়, যার উপর কর্তৃত্ব করা যায়, যার সাথে প্রতারণা করা যায় তবুও এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজ পুরুষের পক্ষেই রায় দেবে। এই জন্য এই সমাজে ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে দেয়া হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্ট্রাকচারের মধ্যেই এই বাসনার বীজ নিহিত।

রশোমন সিনেমাতেও তাই দেখা যায়। একপুরুষের হাত থেকে কেড়ে নিয়ে মহিলাকে অন্য পুরুষ ধর্ষন করে। এইখানে মহিলা একটা খেলা খেলেছিলেন পুরুষতান্ত্রিক পাষবিকতার দিকেই ঠেলে দিয়েছিলেন দুইপুরুষকে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই বিকল্প চয়েস থাকেনা মেয়েদের। বাসে যে মেয়েটি গণধর্ষিত হয়েছে তার কাছে কোনো বিকল্প চয়েস ছিলনা। তাকে বাধ্য হয়েই পুরুষতন্ত্রের এই নির্মম প্রহার সহ্য করতে হয়েছে। এইখানে মেয়েটার আত্মহত্যা অথবা হত্যা সমান। সে বেঁচে থাকলেও সমাজ তাকে অগণিতবার হত্যা করবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্ষকেরাই হত্যা করে ধর্ষিতাকে। 

নারীর কাছ থেকে জোর করে এই সম্মতি আদায় পুরুষ তখন থেকেই করে আসছিল যখন পুরুষ অর্থ উপার্জনের অনেক পথ পেয়ে গেছে। আর নারী সন্তানাদি উৎপাদন ও লালনপালনের ভার নিয়ে নিজেকে গৃহে অন্তরীণ করেছে। ইউরোপে আমেরিকায় নারীরা এখন অনেক বেশি কর্মমূখী, অনেক বেশি ঘরহীণ। কিন্ত তাতে তাদের কর্তৃত্ব খানিকটা বাড়লেও পুরুষতান্ত্রিক চিরাচরিত ধারণার গুহ্যবাসনা থেকে তারা মুক্তি পায় নাই। ইউরোপ আমেরিকায় ধর্ষনের হার আতংকিত হবার মতই।

এর কারণ কি? আমি বলবো পুঁজিবাদ। অনেকেই দ্বিমত করবেন জেনেই বলছি। যেহেতু নারীর ভেতর যথেষ্ট যৌন উপাদান আছে। আর যৌন উপাদান যেহেতু প্রাণিমাত্রেরই মূল চাহিদা। সেহেতু খুব দ্রুত যে তা পণ্য হয়ে উঠবে তা বলতে অর্থনীতির জ্ঞান প্রয়োজন নাই। পুঁজিবাদের চোখে নারী সম্পূর্ণ পণ্য। ঢাকা শহরে যেকোনো মেট্রেসের বিজ্ঞাপনে দেখবেন ভাঁজ করে রাখা ফোমের সামনে এক নারী মডেল কামনামদির চোখ নিয়া বসে আছে। এই বিজ্ঞাপনটা আমাদের কি বলতে চায়? এই বিজ্ঞাপনটা আমাদের বলছে এই ফোমে এইধরণের নারী সঙ্গম উপাদেয়। শুধু ফোমে কেন এমন কোনো পণ্য নাই যার সাথে নারীকে ব্যবহার করা হয় না। ফলে ঠিক পণ্যটি মতই আরেকটা পণ্য হিসাবে আমরা নিজের অজান্তেই নারীকে নিচ্ছি। আর মডেলিং যেহেতু বেশ আয়কর পেশা হিসাবে দাঁড়িয়েছে সুতরাং নারীরাও যে সেদিকেই ঝুকবে তাতে সন্দেহ কি?শুধু কি মডেলিং! হলিউড, বলিউড থেকে শুরু করে দুনিয়ার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের একটা বৃহদাংশই হচ্ছে আসলে পর্ণ ছবির কারবার।

বম্বের প্রায় সিনেমা আসলে পর্ণ সিনেমা। সিনেমার অর্ধেক পুরুষ নায়কটার মারামারি, খুবজখম, চুরি ডাকাতি আর নায়িকাটার আকর্ষণীয় দেহ প্রদর্শন। অর্থাৎ বর্তমান বাণিজ্যিক সিনেমা আমাদের বলছে যে কোনো উপায়ে পয়সা কামাও আর নারী ভোগ কর। নারীদের প্রতি ম্যাসেজ তোমরা নিজেদের দেহকে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তোলো। সেই জন্য আছে হরেকরকম প্রসাধনী। অর্থাৎ দুইটা পেশা এখন সেরা পেশাদার খুনী আর উচ্চাভিলাষি বেশ্যা। শুধু এখানেই স্থীর নাই এই বাণিজ্যিক পরিকল্পনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ নানা উন্নত দেশে গড়ে উঠছে এইচডি পর্ণগ্রাফির ইন্ডাস্ট্রি। ইন্টারনেট ভরে যাচ্ছে সেই সব পর্ণগ্রাফিতে। কি নাই সেখানে! যারা ইন্টারনেটে এসবের খোঁজ রাখেন তারা জানেন, কত হরেকরকম সেসব ওয়েবসাইট। মানুষের সমস্ত নৈতিকতাকে সেখানে নস্যাৎ করা হয়েছে। জবাই করা হয়েছে নীতিবোধকে। মার সাথে ছেলের যৌনতা, বাবার সাথে মেয়ের, দাদির সাথে নাতির, শিক্ষিকার সাথে ছাত্রের, শিক্ষকের সাথে ছাত্রীর,  ছেলের বন্ধুর সাথে মায়ের, ভাইয়ের সাথে বোনের, হাসপাতালের নার্সের সাথে রোগীর, ডাক্তারের সাথে রোগীনির, অফিসের বসের সাথে চাকুরীজীবীর, নানের সাথে পাদ্রির মোটকথা এমন কোনো চরিত্র নাই যাকে এসবের মাধ্যমে কলুষিত করা হচ্ছে না। আর এসব এইচডি পর্ণগ্রাফি পুঁজিবাদের অন্যতম হাতিয়ার বিজ্ঞানের বদৌলতে এত বেশি সহজলভ্য যে, যে কারো মোবাইল ফোনের ভেতর এখন এসবের অবস্থান। নারীর মানুষ হয়ে উঠার সমূহ সম্ভাবনাকেই বিনাশ করেছে এই পর্ণগ্রাফিক সাইটগুলা।সন্দেহ নাই ধর্ষণ অবদমিত যৌন উত্তেজনার আকস্মিক বহি:প্রকাশ।

এই মোবাইল স্ক্রীনে পর্ণছবির কারণে নিরন্তর যৌন উত্তেজনায় ভুগছে ছাত্র, বাস ড্রাইভার থেকে শুরু করে যারা এসবরে ব্যবহার করছেন। ফলে একলা নারীর চলাফেরা যে একেবারেই অসম্ভব হয়ে উঠতে যাচ্ছে তাতে সন্দেহ কি। যে কোন বয়সের নারীকেই ভোগের মাল হিসাবে গণ্য করবার সম্ভাবনার দ্বারে এসে পৌছেছে পর্ণগ্রাফিগুলা। সবকিছু মিলিয়ে এই পর্ণগ্রাফিক ইন্ডাস্ট্রি ফটকা ব্যবসায়ের মতো। সমাজের লাভ ক্ষতি নিয়া তোড়াই কেয়ার তাদের। তাদের দরকার মুনাফা। যতবেশি ডাউনলোড ততবেশি পয়সা। ফলে অসাধারণ সুন্দরীরা সব এখন পর্ণস্টার। পর্ণস্টাররা তারকা হিসাবে উন্নত বিশ্বে যথেষ্ট সম্মান পাচ্ছেন। তার উপর বম্বেতেও পর্ণস্টারদের নিয়া সিনেমা তৈরি শুরু হয়েছে। আর সেই বম্বের সিনেমায় ছয়লাব দক্ষিণ এশিয়া। এই চক্রের ভেতর আবর্তিত হচ্ছে আমাদের দুনিয়া। পুঁজিবাদের পতনের আগে এই পুঁজিবাদি ব্যাধির অবসান কল্পনা মাত্রই মনে হয়। বরং ধর্ষন মহামারি আকারেই ছড়াবে বিশ্বময়। ফলে সামাজিক সমস্যা হিসাবে ধর্ষন নিরন্তর বাড়বে বৈ কমবে বলে মনে হয় না।

No comments:

Post a Comment