Sunday, April 14, 2013

মনোদৈহিক আধিপত্যবাদ


দক্ষিণ এশিয়ার বিগব্রাদার ইন্ডিয়ার চলচ্চিত্রের বাজার শুধু ইন্ডিয়ায় সীমাবদ্ধ নাই। শুধু চলচ্চিত্রের বাজারই বা বলি কেন, হেন কোনো বস্তু নাই যা বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশে যায় না। আর বাংলাদেশের কথা বললেতো প্রায় প্রত্যেক নিত্য ব্যবহার্য পণ্য থেকে শুরু করে সবধরণের ভোগ্যপণ্য এখন পাশাপাশি রাখা হয়। আপনি পেয়াজ কিনতে গেলেন? এইটা বাংলা এইটা ইন্ডিয়ান। কাপড় কিনতে গেলেন এইটা বাংলা এইটা ইন্ডিয়ান। এভাবে থালাবাসন, চালডাল, আলু, লুঙ্গি, চাদর, শাড়ীসহ সমস্ত প্রসাধনের জিনিসপত্রে ঠাসা বাংলাদেশি বিপণীবিতানগুলি। বইপত্র থেকে শুরু করে প্রত্যেক বাংলাদেশি পণ্যের একটা অলটারনেটিভ ইন্ডিয়ান পণ্য আছে।

সবচাইতে বেশি যে পণ্য আমদানি হয় তা ইন্ডিয়ান সিনেমা। বম্বে, গুজরাতি, মারাঠি, কলিকাতার সিনেমায় ঠাসা দোকানগুলো তার ওপর সেটেলাইট টিভিতেতো আছে হরেক রকম ইন্ডিয়ান চেনেলের দাপট। ইন্ডিয়ার সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নির্ণয় করতে গেলে খানিক ইতিহাসে মাথা গলাতেই হবে। অবিভক্ত ভারতের পূর্ব-পশ্চিম বঙ্গ নিয়া বিশাল ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতির অবস্থান ছিল একদা। পশ্চিমবঙ্গ ইংরাজদের শতবছরের রাজধানী হওয়ায় শিল্পকারখানায় পূর্ববঙ্গের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল আর বিনিয়োগকর্তাদের অধিকাংশই ছিল অবাঙালি। যেহেতু পূর্ববঙ্গ শিল্পকারখানায় পিছিয়ে ছিল। তারোপর বাঙালি হলেও অধিকাংশ মানুষই ছিল মুসলমান। গান্ধী প্রমূখ মারাঠাদের একনায়কতান্ত্রিকতার ফলে জিন্নাহ প্রমুখদের দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাগখন্ডে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের নিরিখে পূর্ববাংলাকে পূর্বপাকিস্তান বানানো অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। এরা খানিকটা বাধ্যও ছিল কারণ খোদ পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি হিন্দু বুর্জোয়ারা কখনোই পুর্ববঙ্গের মুসলমান বাঙালিদের তাদের সমকক্ষ হিসাবে দেখতে চায় নাই। ইংরাজদের হাত ধরে ইংরাজি কালচারের অনুকরণের মাধ্যমে নিজেদের ইংরাজ রাজের সেবক হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন তারা। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গবাসী অধিকাংশ মুসলমান হয়েছিল নিম্নবর্গীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ থেকে। মুসলমান হওয়ার কারণে ও ইংরাজরা মুসলমান শাসকদের হটিয়ে ভারতবর্ষের ক্ষমতা দখল করার কারণে ইংরাজদের পক্ষ থেকে যেমন মুসলমানদের দিকে সতর্ক দৃষ্টি ছিল তেমনি মুসলমানদের পক্ষ থেকে ছিল ঘৃণা, ভয় ও অনিহা। আর সবরকমের জাতীয়তাবাদের (ধর্ম,ভাষা,অঞ্চলভিত্তিক) উদ্গাতা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ছিলই।

যাইহোক, শুদ্ধ ধর্ম নিয়া যে রাষ্ট্রচালনা সম্ভব না তা অচিরেই প্রমাণিত হয়ে যায়। তা প্রথম উপলব্ধি করে শাসক পশ্চিম পাকিস্তানিরাই। রাষ্ট্র হিসাবে পশ্চিম পাকিস্তানের আদতে কোনো রাষ্ট্রচরিত্র ছিলনা, এখনো নাই। সবসময় বিদেশি সাহায্য নির্ভর এই রাষ্ট্র। ফলে উৎসমুখ হিসাবে তাকে নির্ভর বা তৈরি করে নিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেই। পূর্বপাকিস্তানকে একটা কলোনি ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারতো না তারা। পূর্বপাকিস্তানের উপর নির্ভর করেই পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বুনিয়াদ তৈরি করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু সাংস্কৃতিক নৈতিকতার কথা বললে জাতি হিসাবে পাকিস্তানি আর বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশ এক ছিলনা। ফলে সাংস্কৃতিক ফারাক থেকে যে বিচ্ছিন্নতার সম্ভাবনা দেখা দিল তার সুযোগ নিল ভারত। বাংলাদেশ পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উপনিবেশ থেকে পরিণত হল ভারতের মননের উপনিবেশে।

এই অসাধ্য সাধন হয়েছিল সাংস্কৃতিগতভাবে বাংলারমানুষ ভারতের সাথে জড়িত ছিল সুদীর্ঘ কাল থেকে। কারণ বাংলার অর্ধেক তো সবসময় ভারতের ভেতর। কিন্তু এই বাংলার অধিবাসীদের ভাষা বাংলা হলেও তারা যে অধিকাংশ মুসলমান সে কথাও ভারতের খেয়াল আছে। কিন্তু ভারতের সমস্যা অন্যজায়গায়। ভারতরাষ্ট্র বহুজাতিক রাষ্ট্র। বহু ভাষাভাষি যুক্তরাষ্ট্র। এক সাথে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটলে ভারত ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবে। হিন্দিকে সবভাষাভাষিদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার আগে তাই ভারতকে অগ্নিপরীক্ষা দিতে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। সেই অগ্নিপরীক্ষার পুলসেরাত হচ্ছে বলিউড বা ভারতের চলচ্চিত্র কারখানা। যেমন আমেরিকার হচ্ছে হলিউড পর্নইন্ডাস্ট্রি।

রাষ্ট্রের শ্রেণিচরিত্র হিসাবে ভারত আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে মিল অনেক দিক দিয়ে। প্রথম মিল হচ্ছে দুইটি দেশই বহুভাষা, বহুসংস্কৃতির মিশেল। কিন্তু এই বহুসংস্কৃতিকে বহুভাষাকে একসুতায় গাঁততে না পারলে রাষ্ট্র হিসাবে টিকে না থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। আর তাই ভাষার সাম্রাজ্যবাদি চেহারা দেখা যায় বিশ্বের তিনটা ভাষায়। চায়নিজ মেন্দারিন, ইংরাজি আর হিন্দি। ইউনেস্কো স্ট্যাটাসটিক্যাল ইয়ারবুক (১৯৯৬) অনুযায়ী দেখা যায়। এই তিনটা ভাষা মাতৃভাষাভাষির চেয়ে ব্যবহারিক দিক দিকে এগিয়ে। চায়নিজ মেন্দারিন ৮০ কোটি লোকের মাতৃভাষা কিন্তু এই ভাষায় কথা বলে ১০০ কোটি মানুষ। ইংরাজি ৩৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা কিন্তু এই ভাষায় কথা বলে ১৯০ কোটি মানুষ। হিন্দি ৩৫ কোটি মানুষের মাতৃভাষা কিন্তু এই ভাষায় কথা বলে ৫৫ কোটি মানুষ। এই চিত্র অনেক আগের তা এখন বেড়ে নিশ্চয়ই দিগুণ হয়েছে। ভারতের অভ্যান্তরীণ ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে দাবিয়ে রাখার জন্য খুবই প্রয়োজন ছিল বলিউড সিনেমা কারখানা। ভারতের প্রত্যেক প্রদেশের মানুষ এখন একাধিক ভাষায় কথা বলে। নিজের প্রাদেশিক ভাষা (মাতৃভাষা), হিন্দি ভাষা ও ইংরাজি ভাষা (কোনোকোনো ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও আছে)। এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ অন্যান্য রাজ্য থেকে একধাপ এগিয়ে। কারণ পশ্চিমবঙ্গ একসময় বৃটিশভারতের রাজধানী ছিল। ফলে ইংরাজিটা অনেক আগে থেকেই কলকাতায় থিতু। হিন্দিটা এখন ক্রমে থিতু হচ্ছে। হিন্দু থিতু হওয়ার পেছনে আগেই বলেছি রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ততো ছিলই তার বাস্তবায়নে সবচাইতে ভূমিকা রেখেছে বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি। বলিউডের এই সম্ভাবনা দেখে অনেক আগেই রাষ্ট্রীয়ভাবে এটাকে ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্প কারখানা হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ইন্ডাস্ট্রি এখন গোটা উপমহাদেশ নিয়ন্ত্রণ করে। 

রাশিয়ায় যখন প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হল, ম্যাক্সিম গোর্কি ছিলেন দ্বিধান্বিত। লুমিয়র ভাইদের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারকে স্বীকার করে নিয়েও তিনি বলেছিলেন ‘শেষ পর্যন্ত মানবজীবন ও মনের উন্নতিতে এই নব আবিষ্কার ব্যবহৃত হবে কিনা, লুমিয়রদের ট্রেনের ছবি, পারিবারিক ছবি শীঘ্রই বুর্জোয়াদের  নগ্ন থাবায় স্থলাভিষিক্ত হবে, তখন ছবিগুলোর নাম হবে ‘যে নারী নগ্ন হচ্ছে,  ‘স্নানঘরে মহিলা, ইত্যাদি। হয়েছেও তাই। সবদেশেই বুর্জোয়াদের চেহারা প্রায় আন্তর্জাতিক। তারা মত্ত সস্তা বিনোদনে। তাদের অন্যতম বিনোদন হচ্ছে যৌনতা। যৌনতা বিনোদন পরিণত হয়েছে এখনকার সবচাইতে লাভজনক ব্যবসায়। হলিউডি বুর্জোয়ারা যৌনফিল্ম উৎপাদন করে কোনো রাখঢাক ছাড়াই তারা যার নাম দিয়েছে পর্ণইন্ডাস্ট্রি। কিন্তু বলিউডি বুর্জোয়ারা খায়েস থাকা সত্বেও সরাসরি পর্ণইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত করতে না পারলেও তাদের প্রকাশভঙ্গি আরো মারাত্মক। যদিও বলিউডে বেশির ভাগ ছবিই পর্ণছবি। কিন্তু তারা এইটার সামাজিকীকরণ ঘটাচ্ছে। খানিকটা সমাজের ভয়ে তারা সরাসরি আগাইতে পারছেনা কারণ ভারতে বহুমানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে। সামন্তীয়রা এখনো ঘাপটি মেরে আছে সমাজের রন্দ্রে তাদের ধর্মকর্মসহ। আর রাষ্ট্রের ব্যাপক অংশ শোষিত জনগণ যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের আফিমের (ধর্ম) ওপর ভর করে। আবার এই জনগণই বলিউডি এই আধাপর্ণ সিনেমা বাঁচিয়ে রাখার শক্তি। যদিও বলিউডি সিনেমায় সাধারণ জনগণের কোনো স্থান নাই। সিনেমায় তারা প্রায় চোর বাটপার, কালোবাজারী। বলিউডি কাহিনীগুলা পাতিবুর্জোয়াদের বুর্জোয়ায় পরিণত হবার খায়েস। বুর্জোয়াদের প্রেমবিলাস তথা শৃঙ্গার তথা কামবিলাসই হিন্দি সিনেমার মূলস্রোত। সেটা বলিউডের সিনেমাগুলা দেখলেই বুঝা যায়। আর এখনতো সিনেমার কাহিনীর ভেতরে অধিকাংশ নায়িকাই বিদেশ থেকে লেখাপড়া করে আসে তারা স্বল্পবসনা, তথাকথিত আধুনিক, যৌনউন্মত্ত এবং বুর্জোয়া পরিবারের। শিক্ষাদীক্ষা শেষে তারা ভারতে আসে তাদের সাথে পরিচয় হয় পেটিবুর্জোয়া বা কোনো লুম্পেন প্রলেতারিয়েতের যার জীবনবাসনা বুর্জোয়া হবার। এরপর বুর্জোয়ার প্রতিরোধের চেষ্টা। অগ্নি পরীক্ষা শেষে তাকে গ্রহণ করে বুর্জোয়া পরিবার। এর মধ্যদিয়ে অধিকাংশ সময় দেখানো হয় বুর্জোয়া মেয়েটার দেহবাসনা। এরমধ্যে আরেকটা শ্রেণিচরিত্র কাজ করে। বলিউডি যে কোনো শ্রেণির নারীই যৌনখাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়। যাইহোক বাস্তবেও তাই বলিউডের প্রায় নায়িকারাই এখন বুর্জোয়া পরিবার থেকে আসা। সবাই প্রায় বিদেশের বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বা বিলাতের স্কুল কলেজে পড়া। প্রিয়াংকা চোপড়া, আমিশা পেটেল, ক্যাটরিনা কাইফসহ অনেকেই আছে। 

 সাম্প্রতিক বলিউডি সিনেমায় ‘আইটেম সং’ বলে একটা জিনিস চালু হয়েছে। এটা যৌনতাকে সামাজীকিরণের আরেকটি ধাপ। নায়িকাদের যে যৌন আচরণ এখনো পর্যন্ত কাহিনীর ভেতর দিয়া দেখানো সম্ভব না তা এই আইটেম সংয়ের মধ্য দিয়ে দেখানো হচ্ছে। সম্প্রতি আইটেম সংগুলা  গোটা সিনেমাকেই হিট করিয়ে দেবার যোগ্যতার প্রমাণও দিয়েছে। এইরকমই তিনটা আইটেম সং হচ্ছে, শিলা কি জওয়ানি, মুন্নি বদনাম হুয়ি, উলালা উলালা। গানগুলা যথাক্রম তিসমারখান, দাবাং ও ডার্টি পিকসার সিনেমার। গান তিনটার কথাগুলা খেয়াল করে শুনলে একটা জিনিস পাওয়া যায়। তিনটারই ভাবার্থ প্রায় অভিন্ন। গানগুলাতে যথাক্রমে ঠোঁট মিলিয়েছেন ক্যাথরিনা কাইফ, মালাইকা অরোরা, ও বিদ্যা বালান। তিনজনই শিক্ষিত সুন্দরী যৌবনবতী ও বুর্জোয়া পরিবার থেকে আসা। তিনটা গানেই যথেষ্ট দেহঝড় তুলেছেন তিনজনেই। তিনটা গানের কথাগুলাই খেয়াল করলে দেখা যাবে খদ্দেরদের সাথে যৌনকর্মীরা যে ধরনের কথা বলে বা দরদাম ঠিক করে প্রায় তার কাছাকাছি। টাকা নিয়া আসো এই ঢেকে রাখা যৌবন উপভোগ করো। 

 যে ধরনের ইনস্ট্রোমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে । যে ধরনের উত্তেজক সুরে গানগুলা বাধা হয়েছে। তাতে একবছর ধরে গোটা উপমহাদেশে ও ভারতীয় চ্যানেলগুলাতে যেগুলা উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরেই প্রতিনিয়ত বেজে চলেছে। বাংলাদেশেও যে কোনো বিয়া বা মেহেদি অনুষ্ঠানে। দূর পাল্লার কোনো গাড়ীতে। যে কোনো অনুষ্ঠানেই বেজে চলেছে এই গানগুলা। স্কুল কলেজে পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীরা কানের মধ্যে মোবাইলের হেডফোন লাগিয়ে নিয়ত শুনছে এই গানগুলা। মোবাইলে ছোট স্ক্রীনে ফাকে ফাকে দেখেও নিচ্ছে। জীবনের, দৈনন্দিনের একটা বিশাল সময়জুড়ে তারা প্রায় নিজেদের অজান্তেই এই চর্চা করে যাচ্ছে অবিরাম।

 এইগানগুলা ঠিক কি ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে’র চাইতেও বড় প্রশ্ন হচ্ছে এই ভারতীয় সিনেমা, গান, সিরিয়াল, বিজ্ঞাপন, সাহিত্য ইত্যাদি মিলিয়ে রাষ্ট্র হিসাবে ভারতের আধিপত্যকে প্রশ্নহীন মেনে নেয়ার ব্যাপারে মননের ক্ষেত্র তৈরি করবে। একটা ভারতীয় সেভের লোশন শুধু লোশন না এইখানে মিশে থাকে সালমান, শাহরুখ, অক্ষয় কুমারের বিজ্ঞাপনি যাদু ও তাদের গ্রহণযোগ্যতা। একটা শ্যাম্পু বা ফেসওয়াস বা ক্রীম শুধু ক্রীম নয় তাতে মিশে থাকে কারিনা কাপুর, ক্যাথরিনা কাইফ, প্রিয়াংকা চোপড়ার গ্রহণযোগ্যতা। এগুলা প্রায় ভোক্তার নিজের অজান্তেই তার মনে গ্রহণযোগ্যতা বা আবেদন তৈরি করে রাখে সম্প্রসারণবাদী ভারতকে, তার আধিপত্যকে গ্রহণ করার ব্যাপারে। ঈদের মার্কেটে মেয়েদের পোশাকের নাম হয় শিলা, মুন্নি ইত্যাদি।

সম্প্রতি ভারতীয় সিনেমাগুলা বাংলাদেশে আমদানি শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে এখনো যেগুলা টিকে আছে। তাতে দেখানো হচ্ছে। যদিও এখনো কলকাতার বাংলা ছবি দেখানো হচ্ছে। কিন্তু ক্রমে পুরানা হিন্দি ছবি ইত্যাদি দেখানোর মাধ্যমে একদম টাটকা মুক্তিপাওয়া সিনেমাও দেখানো হবে। সিনেপ্লেক্সগুলাতে। যদিও সিনেমা হল পর্যন্ত টাটকা সিনেমাগুলা দৌড়ে না আসার কারণ হচ্ছে এমনিতে ডিভিডি, সিডি, টিভি চেনেল দিয়া তারা সেই চাহিদা পুরণ করেছে। 

বাংলাদেশে বইয়ের দোকানগুলা পর্যন্ত ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। বইয়ের লাভজনক ব্যবসা মানে ইন্ডিয়ান বইয়ের ব্যবসা। নিয়মিত যারা শাহবাগের আজিজ মার্কেটের বইয়ের দোকানে যায় তারা জানেন ইন্ডিয়ান বাংলা-ইংরাজি বইয়ের ভীড়ে বাংলাদেশি বইগুলাকে কেমন শীর্ণ দেখায়। সেল্ফের অপেক্ষাকৃত অনালোকিত স্থান হয় তাদের জন্য বরাদ্দ। এখানে বলা অসমীচিন হবে না। আমার প্রবন্ধের বই ‘রাজ্য ও সাম্রাজ্য'র পাঁচটা কপি আজিজ মার্কেটের ‘তক্ষশীলা’ নামের একটা দোকানে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে দিয়েছিলাম। আমার সামনেই একটা কপি সেল্ফের বেশ ভাল জায়গায় রাখল। দু’দিন পর পরিচিত একপাঠক যাকে আমি জানিয়েছিলাম বইটা এই দোকানে পাওয়া যায়। সে বইটা খুঁজে না পেয়ে আমাকে ফোন দেয়। কিছুদিন পর গিয়ে দেখি ইন্ডিয়ান বইয়ের জন্য দোকানে ঢুকা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেল্ফে না দেখে জিজ্ঞেস করলে দোকানের মালিক বেশ বিরক্ত হয়ে বলল, দেখছেন না বই আসছে, কলকাতার বই রাখার জায়গা নাই? একজন লেখক হিসাবে খুবই অপমানজনক অবস্থা। আমি বললাম, আমার বইগুলা আমারে দিয়ে দেন। দোকানি বলল, পরে আইসেন বই নীচে পড়ে গেছে। সন্দেহ করলাম আমার বইগুলা ভাগ্য হয়েছে কলকাতার বইগুলার রক্ষাকবচ হিসাবে, বইগুলার নীচে মেঝেতে। সত্যিকার অর্থেই একদিন অনেক বইয়ের নীচে একেবারে মেঝে থেকে তিনটা বই টেনে বার করলো। ততক্ষণে বইগুলা চেপ্টা হয়ে গেছে প্রায়। এই অভিজ্ঞতা অনেকেরই থাকার কথা।

অবিভক্ত বাংলা হিসাবে মানুষ ইংরাজ আমল থেকেই এদেশেও কলকাতার সাহিত্য পড়েছে।কিন্তু তাও খানিকটা শুদ্রের চোখে ব্রাক্ষ্মণ‌্য সাহিত্য পড়বার মতই। আর কলকাতায় বিষয়টাতো গড়ে উঠেছে একইরকমভাবে, অনেক আগেই। খুব সম্প্রতি অনেকের এরকম অভিজ্ঞতাও হয়েছে যে, কলকাতার জনপ্রিয় কবি সাহিত‌্যিকদের যদি জিজ্ঞেস করা হয়, বাংলাদেশের কাদের লেখা পড়েন? সেক্ষেত্র পাল্টা প্রশ্ন শুনতে পাবেন, ওখানে কারা লিখছে, দুএকটা নাম বলেন? বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসাবে আলাদা ভুখণ্ড পাবার পরও আলাদা কোনো সাহিত্যিক পরিচয় এখনো আমরা অর্জন করতে পারি নাই সেটাও 'প্রভাব' ও 'অবনত গ্রহণে'র কারনে। 

 সেই একাত্তরের পর থেকে। দেশ স্বাধীন হবার পরও এখন অব্দি বাংলাদেশের সাহিত্য, চিন্তা সবই প্রায় কলকাতা নির্ভর। এখনও কলকাতার কবি, সাহিত্যিক, সমালোচকদের মত’ই আমাদের কাছে শ্রেষ্ট। তাদের সনদ না পেলে যেনো এদেশে কবি,সাহিত্যিক হওয়া যায় না। চিন্তা করা যায় না। সেই শামসুর রাহমান থেকে শুরু করে অনেকেই এখনোব্দি কলকাতায় হাজিরা দিয়ে যাচ্ছে ও কলকাতার কবি সাহিত্যিকদের বাংলাদেশে এনে নিয়মিত পায়ের ধূলা ও উপদেশ নিচ্ছে। বিদেশি সাহিত্য আমাদের পড়তে হবে। কলকাতার সব লেখক তৃতীয় শ্রেণির তা বলাও আমার উদ্দেশ্য নয়। ভাল লেখকদের কখনো ডাকি না আমরা ডেকে আনি তৃতীয় শ্রেণির লেখকদের। মুন্নির জওয়ানি, শিলার বদনামির মতই তাদের লেখাজোকা নিজেদের অজান্তে আমাদের মননের ক্ষেত্র তৈরি করে তাদের মত করে, রাষ্ট্র হিসাবে প্রশ্নহীন ভারতীয় আধিপত্য মেনে নেয়ার ব্যাপারে।

লিমন প্রশ্নে রাষ্ট্র অথবা অকার্যকর রাষ্ট্রের শিরা উপশিরা



লিমন নামের এক কিশোরের পায়ে গুলি করেছিল র‌্যাব নামের আইন প্রয়োগ বাহিনীর সদস্যরা। যদিও লিমনের পক্ষে এই দুর্বল অভিযোগ এই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে বিশ্বাস করতে এখনো আমাদের ভয় হয়। তারচেয়ে পুলিশ র‌্যাবের অভিযোগ লিমন সন্ত্রাসী, র‌্যাবকে হামলা করতে গিয়ে তার পা হারাতে হয়েছে, সর্বপরি পঙ্গু ছেলেটির উপর হামলা, তার নামে অস্ত্র মামলা দেয়া ইত্যাদি বিশ্বাস ও সমর্থন পলাতক নাগরীক হিসাবে আমাদের জন্য নিরাপদ। অনেক দিন ধরে লিমন খবরের কাগজের শিরোনাম হচ্ছে। এটা জাতি হিসাবে আমাদের জন্য বড় অস্বস্থিকর। অনেক দিন ধরেই মনে হচ্ছে একদিকে লিমন অন্যদিকে একটি রাষ্ট্র এই সামান্য বিষয় নিয়া অনেক বেশি তর্ক শুরু করেছে। র‌্যাব পুলিশ আইন আদালত রাষ্ট্রের এই স্তম্ভটির বিরুদ্ধে কিসের শক্তিতে এরকম এক ক্ষুদ্র দুর্বল পরিবার অনমনীয়ভাবে লড়াই করার চেষ্টা চালাচ্ছে? তা চিন্তা করতে সক্ষম মানুষমাত্রকেই ইতিমধ্যে ভাবিয়ে তুলেছে। এ নিয়া হাছামিছা অনেক কথাবার্তা চালু হয়েছে বাজারে।

মেকিয়াভেলিয়ানরা ইতিমধ্যেই স্রেফ এই ব্যাপারটা নিয়া রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ কার্যকর কিনা সেই প্রশ্ন তুলবেন। এত ক্ষুদ্র একটা বিষয় নিয়া যেদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এতদিন ধরে ব্যস্ত তটস্থ থাকতে হয় সেই দেশে আদৌ কোনো আইন আছে কিনা সেই সন্দেহও তারা করবেন। বিশেষ করে যে দেশে ক্রসফায়ারের মত বিষয়ও নিরন্তর জারি আছে। তাকে ঢেকে রাখার জন্য যে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাফাই গায় সেরম একটা রাষ্ট্রে এটা অকল্পনীয় বৈকি! রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের শ্রেণিচরিত্র আন্দাজ করতে হলে খানিকটা ইতিহাসের পায়ে ভর করে পেছন দিকে হাটতে হবে। খুব বেশিদূর যাবো না। কারণ ইতিহাস একটা না-গাথা অকল্পনীয় মালার মত যা কেবল সূত্র উৎপাদন করতে থাকবে।

আমি স্রেফ একাত্তর পর্যন্ত ফিরে দেখতে চাই। তাইলে দেখা যায় একাত্তরে বিপ্লব সফল হয় নাই, প্রতি বিপ্লব সফল হয়েছে। অর্থাৎ  অস্ত্রহীন সহায়হীন নিস্বম্বল গণমানুষ পাকিস্তানি জান্তার সমস্ত বুলেট, শিশ্নের প্রহার, দেশিয় দালালদের লোলুপতাকে কেবল আত্মবিশ্বাসের উপর ভর করে কাধে ঠেলে পার করেছিলেন। সাথে যুক্ত হয়েছিল ভারতিয় স্বার্থ। সন্দেহ হয় সেই গণমানুষও সচেতন ছিলেন কিনা তাদের স্বাধীনতা বিষয়ে। অথবা স্বাধীনতা বলতে ঠিক কি বুঝায় তা তারা অনুধাবন করেছিলেন কিনা। অথচ সেই বিজয়ও তাদের থাকে নাই। পরবর্তীকালে গ্রেপ্তার হয়ে যায়। এমন কিছু মানুষ ক্ষমতাকে হাইজেক করেছিলেন যারা নয়মাস যুদ্ধকালীন সময়ে মাঠেই ছিলেন না বলতে গেলে ফলে ‘র’ বা ‘সিআইয়ে’র হাতে দেশের মরা অর্থনীতিকে সমর্পন করতে তাদের হাত কুণ্ঠিত হয় নাই। 

একাত্তরের দার্শনিক ভিত্তি এতই নড়বড়ে ছিল যে পাকিস্তানি শাসকদের দেশিয় দোসর বুর্জোয়ারা, রাজাকাররাও পরবর্তীতে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে সার্টিফিকেট ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে একাকার হয়ে গেছিলেন শাসক গোষ্ঠীর সাথে। অবশ্য সেই সময়ের ভারত পলাতক দেশপ্রেমিক পেটিরা আর রাজাকারদের মধ্যে তেমন তফাৎ ছিল না। ফলে যে সব সাধারণের পুরা পরিবারই নিকেশ হয়েছিল নয়মাস ব্যাপী যুদ্ধে তারা ফের মাঠে ফিরে গিয়েছিলেন নিজের দেহটাকে খাদ্য দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার উসিলায়। বলতে চাই গণমানুষ যেই তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই রয়ে গেলেন। শাসক শ্রেণির নিজস্ব আইন প্রয়োগ বাহিনীর সাথে পাকিস্তানি আর্মি বা আইন প্রয়োগ বাহিনীর বিশেষ কোনো পার্থক্য থাকে নাই। জনগণের সাথে পাকিস্তানি আইন প্রয়োগ বাহিনীর যেইরকম সম্পর্ক ছিল স্বাধীন দেশের শাসক শ্রেণির আইন প্রয়োগ বাহিনী তার ব্যতিক্রম নয়।

শেখ মুজিব তো নিজস্ব একাধিক বাহিনীই গঠন করেছিলেন। শুধু বাহিনীই নয় প্রথম সফল ক্রসফায়ারের জনকও ছিলেন তিনি। সিরাজ শিকদার ছিলেন বাংলাদেশে ক্রসফায়ারের প্রথম শহিদ। তার হত্যার পরও এখন প্রতিটি ক্রসফায়ারের শেষে মিডিয়ায় যেই কল্পিত পাল্টা হামলার গল্প ফাঁদা হয়, সে রকম বলা হয়েছিল। ফলে কাউন্টার হিসাবে এরপর যারা ক্ষমতায় এসেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে তারা নিজের বাহিনী হিসাবেই ভেবেছিলেন। সেভাবেই গড়ে নিয়েছিলেন তাদের। এখনও তা আমরা দেখতে পাই। সরকার গঠন করার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান থেকে শুরু করে বাহিনীতে, সচিবালয়ে, উর্ধ্বতন পদগুলাতে নিজস্ব লোক ঢোকানোর এক তীব্র প্রতিযোগিতা। ফলে রাষ্ট্রের কোনো স্থায়ী চরিত্র কখনোই পায় নাই বাংলাদেশ। বাংলাদেশে প্রায় প্রতিটি শাসক বাহিনীই বাংলাদেশকে 'আমার বাংলাদেশ' হিসাবেই ভেবেছেন।   আমার পিতা বা আমার স্বামীর বাংলাদেশ হিসাবে ভেবেছিলেন। জনগণের বাংলাদেশ নয়।

এসব পানসে জাতীয়তাবাদ শিশু বা বুড়াকে জোর করে ঔষুধ খাওয়ানোর মত প্রায়। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত খানিকটা পৈত্রিক তালুকের মতই এদেশে রাজনীতিও প্রবাহিত হয়ে আসছে। ফলে এহেন হাইজেক স্বাধীনতা থেকে জনগণ যে নামমাত্র মুনাফাও তুলতে পারে নাই তার বড় প্রমাণ আজ বরিশালের পা কাটা লিমন।যেন সেই যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নাই। এখনো হানাদার বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের গুম করে ফেলছে, হত্যা করছে, যত্রতত্র গুলি করে সন্ত্রাসী বলে চালাচ্ছে। রাস্তা থেকে তুলে নিয়া নিরপরাধ কিশোরী তরুণীদের গণধর্ষণ করে ক্ষতবিক্ষত লাশ ফেলে দিচ্ছে। আগে তাদের উপর এই ধরনের অত্যাচার চালানো হতো মুক্তিবাহিনী বলে। যেন ক্ষমতার মসনদে সেই বিদেশিরাই বসে আসে। আসলেও তাই বাংলাদেশ মানে এই অঞ্চল সবসময় শাসিত হয়েছে বিদেশিদের দ্বারা। আর্য, মোগল, ইংরাজ, পাকিস্তানি।

একাত্তরের পর থেকে যারা বাংলাদেশের ক্ষমতাকেন্দ্রে আছে তারাও মননে বিদেশি, যতই জাতীয়তাবাদের জিগির তুলুক না কেন। আমলা থেকে পাতি নেতা পর্যন্ত সবারই সামান্য সর্দিজ্বর হলে সিঙ্গাপুর চলে যায়। এদের সন্তান লেখাপড়া করে বিলাতসহ ইউরোপ আমেরিকায়। এরা অবকাশ যাপন করে ব্যাংককে, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডে। আবার অবসর নেয়ার সাথে সাথে তারা অভিবাসী হয়ে চলে যায় বিদেশে। খোদ শেখ হাসিনার সন্তান পাকাপাকিভাবে থাকেন আমেরিকায়। বোনেরা থাকেন ইংলন্ডে। খালেদা জিয়ার সন্তানাদিও তাই। দেশগুলাতে জনগণের জানমালের নিরাপত্তার বুর্জোয়া নীতিবাদেও তাদের বিশ্বাস নাই। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণির চরিত্র লুণ্ঠনকারীর মতই। এই দেশটা আসলেই তাদের লুণ্ঠনের ক্ষেতে পরিণত হয়েছে। এই জন্য রাষ্ট্রটা খানিকটা আধা সামন্তীয় চেহারায় জনগণের সামনে খাড়া হয়। বলাই বাহুল্য বাকী অর্ধেক বুর্জোয়াদের। 

লিমন বা তার পরিবার একটা সিম্বল। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর হাতে অসহায় শত শত পরিবারের একটি। এই পরিবারও হয়তো জানে যে কোনো মুহূর্তে গোটা পরিবারটাকেই নিকেশ করে দিতে পারে। অজস্র খুনের কোনো আগামাথা পাওয়া যায়না যেই দেশে সেখানে এটা খুবই স্বাভাবিক। তবুও তারা ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করছে সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে। শত শত পরিবার জানে তাদের অবস্থাও এরচেয়ে ভাল নয়। তবুও তারা লিমন বা তার পরিবারের পক্ষে দাড়াচ্ছে না। দাড়াবে না। কারণ তারা বাধা রাজনৈতিক রজ্জুতে। রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতার কারণে রাষ্ট্রের শিকার হওয়া মানুষ যখন কোনো ভাবেই প্রতিকার পেতে ব্যর্থ হয় হয়ত তাকেই বলে ফেসিজম। এই ফেসিজম শুধু সরকারের এজেন্ডা থাকেনা। যার প্রভাব জনগণের চরিত্রেও পরিলক্ষিত হয়। যেমন আমরা ইদানিং দেখছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মদদে জনগণ ডাকাত সন্দেহে নির্মমভাবে পিটিয়ে মারছে জনগণকে। যেমন আমিন বাজারের বড়দেশি গ্রামে ছয় ছাত্রকে পুলিশের উপস্থিতে গ্রামবাসীরা নির্মমভাবে পিটিয়ে মারলো। নোয়াখালীতে এক নিরপরাধ কিশোরকে পাগলা কুকুরের মত পিটিয়ে মারলো জনগণ। এরও উস্কানিদাতা ছিল পুলিশ বাহিনী।

বাংলাদেশের থানাগুলার কথাই ধরা যাক। হরর সিনেমার মত লাগে। অভিযোগ দিতে গেলে টাকা। সার্জসিট দিতে গেলে টাকা। জিডি করতে গেলে টাকা। আসামী ধরাইতে গেলে টাকা। যে আসামী পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে গেলেও টাকা। আবার আসামী পক্ষের টাকার জোরে রাতারাতি বদলে যাচ্ছে মামলার ধরণ। তাহলে তথাকথিত রাষ্ট্রীয় ন্যায় বিচারের ধারণাটা এখানে কি দাড়াচ্ছে? এবং এই ফেসিজম অকার্যকর রাষ্ট্রের আরেকটি উৎকৃষ্ট উদাহারণ। বাংলাদেশের জনগণ শাসকশ্রেণির নির্ভরতার জায়গা নয়। শাসন বা শোষনের জায়গা। তাদের নির্ভরতার জায়গা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। ফলে মার্কিনি ও ভারতিয় পলিসির লগে নিজেদের খাপ খাওয়াতে তারা যত ব্যস্ত সময় কাটায় তার কিয়দাংশও জনগণের জন্য ব্যয় করে না। এইটা হচ্ছে অকার্যকর রাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষণ। অন্যদিকে নিত্যপণ্যের দাম বিদ্যুৎ আইন ব্যবস্থায় সরকারের কোনো আগ্রহ না থাকায় দেশে নিত্য গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি বিরাজমান। সরকার প্রধানদের তথাকথিত আশাবাদ ও উন্নয়ন বিষয়ক মিথ্যাচার বাদ দিলে শাদা চোখে আমরা দেখতে পাই এক নিরব দুর্ভিক্ষ বয়ে বেড়াচ্ছে পুরা জাতির নিম্নবিত্ত ও নিম্মমধ্যবিত্তরা।

তরি তরকারি ফলমুল মাছমাংসে ফরমালিন আজ সতসিদ্ধ বিষয়। গণহারে মানুষ বাজার সিন্ডিকেটের বলি হচ্ছে নিয়ত। কেনসার খুব দ্রুত মহামারি আকার ধারণ করবে বলে মনে হচ্ছে দেশে। অন্যদিকে বাড়ছে ঔষুধের কোম্পানি। কারণ ঔষুধ কোম্পানির পোয়াবারো মানেই মানুষের সর্বনাশ। চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন ডাক্তার আর ঔষুধ কোম্পানী যৌথ ব্যবসা। খাদ্য বিষক্রিয়ার যেন এক নিরব গণহত্যাই সংগঠিত হতে চলেছে দেশে।অন্যদিকে দেশকে ভেতর থেকে কুরে খাচ্ছে মেকনামারার এনজিওগুলা। নানান এজেন্ডায় নানান কিসিমের রূপ ধরে তারা বিভ্রান্ত করছে মানুষকে। সুদখোর ইউনুসের মত একজন এনজিও কর্মীও একটা রাষ্ট্রের চেয়ে ক্ষমতাবান। এসবই অকার্যকর রাষ্ট্রের শিরা উপশিরা।

মেকনামারার এনজিও পলিসির পেছনে ছিল আসলে রাষ্ট্রকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার কৌশল। সরকারের সব কাজ নিয়াই আসলে সওদা করে এনজিও গুলা। রাষ্ট্রের ভেতর থেকে সরকারকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হতে না দেওয়াও তাদের অন্যতম এজেন্ডা। দেখা যাচ্ছে বৃহৎ জনগণের কাছে সরকারের কাজ সাম্রাজ্যবাদিদের লাঠিয়ালের মত। বলা হয়ে থাকে দুনিয়ার তাবৎ সেনাবাহিনীই মার্কিন সেনাবাহিনী। দুনিয়ার এমন রাষ্ট্র নাই যেখানে মার্কিন সেনাবাহিনী নাই। যেখানে স্বমূর্তি রূপে তারা নাই সেখানে তৃতীয় বিশ্বের সেনাবাহিনী থেকে নিয়েই এমন বাহিনী তারা গঠন করে যাকে মার্কিন সেনাবাহিনী হিসাবেই গণ্য করা হয়। তাদের বেতনভাতা সবই মার্কিন বহন করে।বিশেষ করে ভিয়েতনামে পরাজয়ের পর তৃতীয় বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের পলিসি বিস্তর পরিবর্তিত হয়েছে।

এখন হানাদার অন্যদেশ থেকে আক্রমণ করে না। তাদেরকে স্বজাতির ভেতর থেকেই তৈরি করা হয়। এরা আমাদেরই ভাই বেরাদর এলাকাবাসী। একেকটা বাহিনীতে যোগ দেয়ার পর তাকে অন্ধ করে দেয়া হয়। তার কাজ হচ্ছে মানুষ হত্যা। মানুষের সাথে প্রতারণা করা। অর্থাৎ সিস্টেম তাকে চালনা করে নিজস্ব সফটওয়ারে। তাকে বলা হয় এই তার চাকুরি। অ্যাডওয়ার্ড সাঈদ এক সাক্ষাৎকারে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তিনি নিজেই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করছিলেন এক মার্কিন সেনার। সাঈদ সাহেব মার্কিন সেনাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি সেনাবাহিনীতে ঠিক কোন কাজটি করেন? জবাবে মার্কিন সেনা বলেছিলেন, তিনি বিমান নিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে রাষ্ট্র প্রদত্ত টার্গেট পুর্ণ করেন। তার মানে কি আর খুলে বলতে হবে? তার মানে রাষ্ট্র তাকে যেই পরিমাণ মানুষ হত্যা করতে বলেছে সেইপরিমাণ মানুষ হত্যার চেষ্টা চালান তিনি। এইটা স্রেফ একটা চাকুরী হিসাবেই দেখা হচ্ছে। এই টার্গেট পুরণের মাধ্যমেই আসছে তার পরিবারের সচলতা। রাষ্ট্র খোদ নিজেই বদলে দিচ্ছে ন্যায়ের সংজ্ঞা। একথা সবাই জানেন রাষ্ট্রের মত একটা দমনপীড়নকারী প্রতিষ্টান তার ক্ষমতা ও তার বিকিরণের মাধ্যমে নিয়ত নতুন নতুন ন্যায়ের জন্ম দিয়ে থাকে। রাষ্ট্রের চরিত্র এক কথায় চমৎকার ব্যক্ত করেছিলেন ভ্লাদিমির লেলিন তার 'রাষ্ট্র' বক্তৃতায়। তিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্র হচ্ছে এক শ্রেণি কর্তৃক অন্য শ্রেণিকে শোষণ করবার যন্ত্র মাত্র।

শোষক পুঁজিপতিদের রক্ষা ও বিদেশি শক্তির দাসত্ব ছাড়া তৃতীয় দুনিয়ার ক্ষমতাবানরা চলতে পারে না। জনগণ তাদের কাছে স্রেফ বাজার। তাদের মারো, বেচো, তাও সংবিধানসম্মত। সেই চির বঞ্চিত, লাঞ্চিত ও শোষিত জনগণেরই প্রতিনিধি আজ লিমন। ক্রসফায়ারে পরেও বেঁচে গিয়ে লিমন কাল হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। তার পায়ে গুলি করে তাকে পঙ্গু করা হয়েছে। তার কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে বলে তাকে অস্ত্র মামলায় ফাসানো হয়েছে। আবার মানুষকে বুঝানো হচ্ছে এই গাজাখুরি গল্প। অচেতন অবস্থায় তার চারদিকে ছড়ানো ছিটানো ছিল অনেক অস্ত্র ও বন্দুক। লিমন যদি অচেতনই ছিল তাহলে তার কাছ থেকে কিভাবে অস্ত্র উদ্ধার হলো, যদি ১৫ মিনিট ধরে ১৫ রাউন্ড ফায়ার হয় তাহলে সেই খোসা আর অস্ত্রগুলো কই?
লিমন যখন এদেশের আদলতে বারান্দায় কাঁদে, তার সাথে কাঁদে বাংলাদেশে আত্মা। কারণ লিমনই প্রকৃত ভূমিপুত্র। বিদেশি ট্রেনিংপ্রাপ্ত আইনের পোশাক পরা হত্যাকারীরা নয়।

ববিতা বড়ুয়াকে কি করে বাঁচাবো?


মেরুংলোয়া বড়ুয়াপাড়ার দিকে ঢুকবার আগে সীমা বৌদ্ধবিহারের গেইটে এসেই আমার মনে পড়লো ববিতার কথা, আকস্মিক। কারণ এই সেই গেইট আজ থেকে ১০ বছর আগে আমি এখানে খুঁজতে এসেছিলাম ববিতাদের বাড়ি। আর এখন খুঁজতে এসেছি অজস্র পোড়া বসতবাড়ি। গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল বারবার। কিছুদিন ববিতা আমার খুবই কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। কারণ সে কবিতা ভালবাসতো। ভাল কবিতা আবৃত্তি করতো। অবশ্য ববিতার বাড়িতে আসার পেছনে ছিল সেই দুর্দমনীয় ধর্মীয় বিধিনিষেধ ভাঙার চেষ্টা। আমি প্রথম ববিতার কাছে শুকরের মাংস খেতে চেয়েছিলাম। কারণ এই জিনিস কেবল মাত্র বড়ুয়ারা খায় এইদিকে। প্রথমে গররাজি হলেও আমার অনমনীয়তার কাছে ববিতা হার মানে। একদিন ববিতা আমার কাঙ্খিত মাংস রান্না করে দাওয়াত করেছিল। এর আগে কোনোদিন আমি ববিতাদের বাড়ি যাই নাই। যদিও কক্সবাজারে সংস্কৃতিক রাজধানী রামুতে গেছি অনেকবার। সীমাবিহারের গেইট দিয়ে ঢুকেছিলাম ঠিকই কিন্তু ববিতার বাড়ি খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। ববিতাই খুঁজে বের করেছিল আমাকে।  কিন্তু ববিতার বাবা আমতা বাধা দিয়েছিল কিন্তু ববিতা বলেছিল ‘জাহেদ্যা আধা বউরগ্যা’। আমার বৌদ্ধপ্রীতি সম্পর্কে ববিতা খানিকটা অবহিত ছিল।...


আজ এত বছর পর আমি আবার সীমাবিহারের গেইট দিয়ে ঢুকছি, এইবার আমার লক্ষ্যবস্তু মানে বড়ুয়াদের পুড়ে যাওয়া বসতবাড়ি খুঁজে পেতে আমার বেগ পেতে হয় নাই। কারণ তা দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল। সীমা বিহারের গেইট দিয়া ঢুকতেই নাকে এসে ধাক্বা মারে পোড়াগন্ধ। বৃষ্টির কারণে কালো হয়ে আছে রাস্তার কাদামাটি। ক্রমে আতংকিত বড়ুয়াদের অজস্র মুখ আমাকে অপরাধী করতে করতে পাশ কেটে যায়। এইটা মুসলমান হিসাবে নয় একজন মানবজাতির সদস্য হিসাবেই। 


প্রথম যে কয়টা ঘর আগুনে ভস্ম করা হয়েছিল। আগুনের তাপে ফেটে যাওয়া দেয়ালের প্লাস্টার। একসাথে উকি দেয়া বড়ুয়া মহিলাদের আতংকিত মুখ।যারা একমাত্র পরণের শাড়িটাই বাঁচাতে পেরেছিল।  সেগুলা খুঁজে পেতে আমার কষ্ট হয় নাই। এগুলা দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল। এইখানকার এক মেয়ের সাথে আমার পরিচয় ছিল। মনে হচ্ছিল তাদের বাড়ি আরো ভেতরের দিকে। যাদের বাড়িতে আমি প্রথম শুকরের মাংস খেয়েছিলাম। ববিতার নামটা তখনো মনে পড়ছিল না। চেষ্টা করতেছিলাম কোন এক নায়িকার নামে নাম ছিল যেন মেয়েটার। কি নাম কি নাম। মেয়েটা রামু কলেজের কম্পিউটার ইন্সট্রাকটর। কি নাম কি নাম। এইটা ভাবতে ভাবতেই একটা পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে এসে পড়ি।


অমায়িক, অসহায় দোকানি বর্ণনা করছিলেন সেই বিভীষিকাময় রাতের। গল্পটা তিনিই প্রথম আমাকে বলেন যে, একবাড়িতে মুসলমানরা বাড়ির সকল সদস্যকে ভেতরে রেখে তালা মেরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারা পেছন দিক দিয়া পালাতে সক্ষম হয়েছিল। বাড়ির কোনো জড়বস্তুই বাঁচতে পারে নাই। দুইটা ডেস্কটপ একটা লেপটপ। চারটা পড়ার টেবিল। দুইসেট সোফা। সত্তর হাজার টাকা। বাড়ির ছয় সদস্যের জামাকাপড় খাট বিছানা তোষক বালিশ কিছুই বাঁচতে পারে নাই। দোকানি আমাকে অনুরোধ করল আমি যেন তার সাথে ভেতরে গিয়া বাড়িটা দেখে আসি, বলল সে মিছা বলছে না। আমার চোখে কি তার কথা নিয়া সন্দেহ ছিল কোনো? হয়তো বা।


দোকানের পেছন দিয়া সে আমারে নিয়া যায় বাড়িটায়। ঢুকতেই এক বয়স্ক ফর্সা রাগান্বিত মুখ দেখতে পেলাম। সাদা লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্চাবি পড়ে বয়স্ক মানুষটি ধ্বংশস্তুপের মধ্যে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন। এক দৃষ্টিতে  তাকিয়ে আছেন সামনে বৃষ্টির সাথে ভেসে যাওয়া কালো পানির দিকে। ঘরটার কালো দেয়াল ছাড়া অবশিষ্ট কিছু নাই। সকালে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এসে উপরে তাবু লাগিয়ে গেছে। ফাঁকফোকর দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে।
হঠাৎ মানুষটা বলে উঠে নিজে নিজেই, যেন তিনি কাউকে উদ্দেশ্য করে বলছেন না এসব,
কোনো দিন তো বড়ুয়া মুসলমান আলাদা করে দেখি নি?
কেঁপে উঠি।
তিনি বলে উঠেন, আমার একমেয়ে রামু কলেজে চাকরি করে, আরেক মেয়ে বিসিকে, আরেক মেয়ে প্রাইমারি স্কুলে।
চমকে উঠি।
ততদিনে ববিতা কোথায় কাজ করতো সেসবও মনে নাই আর। হঠাৎ ভেতরের দিক থেকে ভেসে আসলো এক নারীকণ্ঠ, কে আসছে ওখানে বাবা..। 
দেখেই চিনতে পারলাম তাকে।
ববিতার বড়বোন। করবীদি আমাকে চিনতে পারেন নাই। বললেন আপনারা কোত্থেকে এসেছেন। রাগান্বিত করবীদির কণ্ঠস্বর। আমি বাকরুদ্ধ। আমি কোত্থেকে এসেছি? কোত্থেকে? কেন এসেছি এইখানে, নিজেও কি বুঝি? সেসব প্রশ্ন আমিও নিজেকে জিজ্ঞেস করছি। কেন, কেন, কেন?
করবীদি কিছু বলার আগেই তার বাবা মেলে দিলেন নিজের দুই হাত। যেখানে আগুনে পোড়া দুইটা দাগ দেখতে পাচ্ছি। আমি ভাবছি আর মনে মনে বলছি কবরীদি যেন আমাকে চিনতে না পারে। এখনো চিনতে পারে নাই। দশবছর আগে মাত্র একবার দেখা হয়েছিল তার সাথে, চেনার কথা না। যদিও আমার চোখ খুঁজে চলে ববিতাকে কিন্তু বাসনা করছি ববিতার সাথে যেন দেখা না হয়। দশবছর পর এরকম এক মুহুর্তে একদার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর মুখ দেখে সহ্য করতে অনেক শক্ত হতে হয় মানুষের মন। আমি কি অত শক্ত হতে পেরেছি?
নিজের অজান্তেই চলে যাই ভেতরের রুমে। যেখান থেকে পুরা পোড়াবাড়িটা দেখা যায়। পোড়া জানলা দিয়া তাকাতেই চোখে পড়লো এক তরুণীকে হয়তো সে গোসল সেরে ঢুকে যাচ্ছে রান্না ঘরের মতো নিচু একটা ঘরে। মাথায় ভেজা গামছা পেছানো মুখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা। সত্যিকার অর্থে আমি তখনও চিনতে পারি নাই ববিতাকে।
হঠাৎ ফিরে জিজ্ঞেস করলাম মানুষটাকে, আপনার সেই মেয়েটা কোথায়, যিনি রামু কলেজে চাকরি করেন? 


ববিতা, ববিতা বলে হাক মারেন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তিনি। একটু পরেই রুমটায় এসে হাজির হলো ববিতা। ববিতার সেই দরাজ কণ্ঠ। রুমে ঢুকেই বলে কে কে আমাকে ডাকে? আমি মুখ লুকাতে পারলে বাঁচতাম। ববিতা আমার মুখের দিকে তাকায়। সে মুখ ফেরাতে পারে নাই। ফের তাকায়। কে তুই? চিৎকার করে উঠে সে মনোরোগীর মত। জা ... হে... দ্যা?


ববিতা চিনতে পারার পর ঘরের সবার চোখ আমার দিকে জড়ো হয়। চোখগুলা আমাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে। ববিতা বলে চলে, জাহেদ্যাকে চিনতে পারছেন না,আপনারা? সেই আধা বউরগ্যা। আমাদের বাড়িতে এসেছিল, শুকরের মাংস খাওয়ার জন্য।
করবীদি চিনতে পারে। মাসিমা চিনতে পারে। মাসিমার কান্নাসিক্তমুখটা আমার বুকে রেখে ফুফিয়ে উঠে। আমি ঘুরছি সব স্মৃতিফৃতিসহ, ঘুরছে আমার অস্তিত্ব।  ববিতা আমাকে হাত ধরে ভেতরের দিকে নিয়া চলে। নিতে নিতে দেখাতে থাকে আগুন কোথায় লাগানো হয়েছিল, কিভাবে বাড়ির টিনের চালে সে সবাইকে তুলে দিয়ে নিজেও লাফ দিয়ে বেঁচেছিল। কিভাবে পাথর এসে পড়ছিল তাদের মাথায় মুখে পিঠে। সে সব বলতে বলতে বাড়িটা প্রদক্ষিণ করলাম আমরা। এই কঠিন বাস্তবতা ভেদ করে দশবছর আগের স্মৃতি ডানা ঝাপটাচ্ছিল। কত বদলে গেছে ববিতা। এখন তাকে চেনাই যাচ্ছে না। হয়তো এতদিন বদলায় নাই, সেদিন রাত থেকেই... তার সদা হাসোজ্জল মুখটা পরিণত হয়েছে করুণ, মর্মান্তিক,আতংকিত, সন্দেহ পরায়ণতায়।  
আমাদের বাড়িতে কি কি ছিল তা তুই জানিস? আমি মাথা নাড়ছি হ্যা। সোফাগুলাতে তুই বসছিলি? হ্যা আমি মাথা নাড়ছি। মনে আছে সেই টেবিলটা? আমার আবৃত্তির ক্যাসেটগুলা? কত কবিতা? তুইযে একটা ক্যাসেট মেরে দিয়েছিলি মনে আছে? 
আমি দুনিয়ায় অনেকের কাছ থেকে কত বই, ক্যাসেট, টাকা নিয়া ফেরত দিই নাই তার কোনো হিসাব নাই। কিন্তু আজ খুবই অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। ববিতার ক্যাসেট টা কোথায় আছে খুঁজে দেখতে হবে। ফেরত দিতে হবে। কারণ তারতো এখন কোনো ক্যাসেট নাই। তার সব বইগুলা পুড়ে গেছে।


তুই কি কখনো মুসলমান ছিলি? আমি কি কখনো বড়ুয়া ছিলাম? আমরা তো মানুষ ছিলাম, বন্ধু ছিলাম। তার অবিশ্বস্ত চোখ সম্মতির জন্য আমার নতচোখের দিকে তাকায়। আমি এরকম লজ্জা কোনোদিন পাই নাই। পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল। এই মুসলমানিত্ব, হিন্দুত্ব, বড়ুয়াত্ব ছেড়ে, অন্য কোনো দুনিয়ায় যেখানে বন্ধুত্বই একমাত্র সহায় হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষান্ত হয় না। সে আমাকেই যেন অপরাধী ভেবেছে, যেন তার সমস্ত অভিযোগ আমার বিরুদ্ধেই। 


আমাকে কিভাবে বাঁচাবি তুই, কিভাবে দাঁড় করাবি এই ভাঙ্গা ঘর? কিভাবে ফিরিয়ে নিয়ে আসবি সেই সম্প্রীতি? 


ভেবে চলেছি, ভেবে চলেছি আমি নিরন্তর এই পুঁজিবাদের সৃষ্ট আবর্জনার স্রোত সম্প্রদায়-অন্ধ জনগণের প্রতিনিধি হিসাবেই  'ববিতা বড়ুয়াদের কিভাবে বাঁচাবো আমরা ?'

ম্যাডোনার ট্যাটু ও মালালা ইউসুফজাইর সংবাদ হয়ে উঠা


১৪ বছরের পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাই দুনিয়ার এখন শীর্ষসংবাদ। বিশ্বমিডিয়া মালালার ব্যাপারে যে রকম সহানুভূতি দেখাচ্ছে মানবিকতার দোহাই দিয়া তা শুধু মানবিকতায় আবদ্ধ কিনা তা খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে। বিশেষ করে ম্যাডোনার মত পপ শিল্পী নিজের উন্মুক্ত আবেদনময় দেহে মালালার নামে ট্যাটু লাগিয়ে হাজার হাজার দর্শকশ্রোতার সামনে তা পরিদর্শন এবং তার নামে গান উৎসর্গ করে বিশ্ব মিডিয়ায় সংবাদটার গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়া কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা কিনা তা নিয়াও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।পশ্চিমা মিডিয়া দুইভাবে কাজ করে। প্রথমত তারা সংবাদের ভিত্তি ও উৎস তৈরি করে। দ্বিতীয়ত হয়ে উঠা সংবাদকে নিয়ন্ত্রণ করে।

সেইটা ম্যানুফেকচারিং কনসেন্টে নোয়াম চমস্কি ও এস হারমান বিস্তারিত দেখিয়েছেন। সেই ঘটনা পুরানা। আবার এটা বলাও আমার উদ্দেশ্য নয় যে মালালা মিডিয়ার সৃষ্টি। শুধু মালালা নয় তৃতীয় বিশ্বে অনেক প্রগতিপন্থী মানুষ এই ধর্মীয় কুপমণ্ডুকতার ব্যাপারে সোচ্ছার। কিন্তু সোচ্ছার হলেও এই প্রগতিশীলরা এখন চরম বিপজ্জনক অবস্থানে আছেন। কারণ একদিকে ধর্মীয় কুপমণ্ডুকতা অন্যদিকে তাদের সৃষ্টিকর্তা সাম্রাজ্যবাদ। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বসহ গোটা দুনিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে ঠাণ্ডা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মার্কিন-সোভিয়েত বিরোধকে কেন্দ্র করে নতুন করে ধর্মীয় ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। আজকের যেই অন্ধ পশ্চাৎপদ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়া মালালা নির্মমতার শিকার । তারও জন্মদাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বলা যায় সাম্রাজ্যবাদ নিজের লেজই কামড়ে চলেছে এখন।

তৃতীয় বিশ্বের প্রগতিশীলরা যেন চিন্তার পুলসেরাত পার হচ্ছেন। কারণ তাদের তীব্র সতর্কাবস্থায় চিন্তা করতে হচ্ছে যে তালিবান বিরোধীতা যেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষপাত হয়ে না যায়। সেইরকমই এক সমস্যাসঙ্কুল অবস্থার ভেতর পড়েছেন মালালা ইউসুফজাই। মালালা তালিবানদের বিরুদ্ধে সোচ্ছার হয়তো তার নিজের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতেই। পুঁজিবাদের খাদ্য সাধারণ গণমানুষ। সেই গণমানুষের দ্বারাও শোষিত আরেক শ্রেণি হচ্ছে নারী। তৃতীয় বিশ্বেতো বটেই তালিবানদের দ্বারা বিশেষভাবে শোষিত ও লাঞ্চিত এই নারীগোষ্ঠী। নারীকে বস্তাবন্দী করে রাখার যেই ধর্মীয় রাজনীতি তা শ্রেণিযুদ্ধে পর্যবসিত হতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না। তার দায় মানুষের স্বভাবের। আর স্বভাব তৈরি হয় তার অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর। যে জন্য তৃতীয় বিশ্বে অহরহ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পুরুষের হাতে নারী ও শিশুহত্যা সংগঠিত  হচ্ছে নিয়ত।

তালিবানরা আমেরিকার মত শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও বিভিন্নভাবে নিরন্তর মারখাওয়ার ফলে শ্রেণিশত্রু হিসাবে তাদেরকেই তারা টার্গেট করছে যারা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী কিন্তু যাদের মতামত তাদের বিরুদ্ধে। ফ্যাসিজমের দিক দিয়ে তারাও সাম্রাজ্যবাদের কাছাকাছি। যারা আমাদের পক্ষে না তারা আমাদের বিপক্ষে। এই তাদের ন্যায়। অন্যদিকে শক্তির অবদমন হিসাবে তারা ধর্মের দোহাই দিয়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল করে রাখা নারীদের ব্যাপক শোষণে উৎসাহী। তারা যে শুধু নারীকে শিক্ষা ও সুবিধা বঞ্চিত করে অন্ধকার বোরখার ভেতরই আবদ্ধ রাখতে চায় তা না। তারা ব্যাপক ধর্ষণ বা ভোগের উপকরণ করে রাখার পক্ষপাতিও।

নারীপুরুষ নির্বিশেষে যে সব মানুষ, মানুষের স্বাধীনতায় আস্থা রাখে তারা এমন ঘটনা কোনোদিনও মেনে নিতে পারে না। ঠিক এই ধারার একটা ছোট প্রতিবাদের শিখা ছিল মালালা। কিন্তু বারুদ ছোট হলেও যে ব্যাপক গ্যাসক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটেছে যেখানে বিস্ফোরিত হবার জন্য উন্মুক্ত হয়েছে মানবিক বিষ্ফোরক। সেই ক্ষেত্র মালালাকে লুফে নিয়েছিল। আর তাই তালিবানদের বুলেট খুঁজে নিয়েছে মালালাকে। মালালাদের মত বিপ্লবীদের কোনো সংগঠন নাই। তাদেরকে একাই লড়তে হয়। আর তাই যে কোনো মুহূর্তে হেরে যাবার, মরে যাবার বা ব্যবহৃত হবার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। হয়তো মৃত্যু তাদের জন্য অনেক ভাল এমনকি বেঁচে থাকার চেয়েও।

মালালা এখন মার্কিন ও পাকিস্তানি বুর্জোয়াদের প্রিয় ফুলে পরিণত হয়েছে। মালালাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের জনমত আরো তালিবান বিরোধী ও নিজেদের আরো বেশি মানবিক প্রমাণ করার জন্য তারা উঠেপড়ে লেগেছে। সম্মতি উৎপাদনে মালালা বিশেষ অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান সরকার মালালার খুনীদের মাথার জন্য লাখ লাখ টাকা বাজি ধরেছে। আমিরিকাসহ বিশ্বমিডিয়া দারুণ প্রচার দিচ্ছে মালালাকে। এমনকি যৌনআবেদনময়ী গায়িকা ও নায়িকা ম্যাডোনার খোলা দেহে মালালার নাম খোদাই হয়ে গেছে।হলিউডের পুরা ইন্ডাস্ট্রিটাই প্রায় মার্কিন বুর্জোয়াদের দখলে। তাদের অধিকাংশই জায়ানিস্ট। মেডোনার জেরুজালেম কানেকশান স্বতসিদ্ধ বেপার। তিনি ঘোষণা দিতেও কসুর করেন না। তো মেডোনার গ্রহণযোগ্য আসলে কিসে? সেই গ্রহণযোগ্যতার সাথেই কিন্তু মালালাকে মার্কেটিং করা হচ্ছে। এইখানে মার্কেটিং শব্দটা কঠিন শোনালেও সেইটা সহ্য করবার সময়তো চলছে। অ্যারাইবাল বইলা একটা ডকুমেন্টারিতে একবার দেখানোর চেষ্টা করছিল তারা যে মেডোনার গানের কথাও নিয়ন্ত্রিত হয় জেরুজালেম দ্বারা, তার স্পন্সরদের মধ্যে প্রায় সবাই জায়নিস্ট। তো এই যুদ্ধের গোড়ার ফিরে গেলে বুঝা যাবে মালালাও বস্তুত ড্রোনের শিকার।এতে করে ম্যাডোনার যৌনতার সাথে মালালাকে ব্র্যাণ্ডিং করা হচ্ছে। ম্যাডোনার দেহভঙ্গি ও কামকণ্ঠ গিলতে আসা হাজার হাজার দর্শকশ্রোতা ম্যাডোনা কেন্দ্রিক যৌন অনুভূতির সাথে মালালাকেও সম্পৃক্ত করে নিল। আর সেই প্রচারে আরো বেশি ক্ষোভ ও ঘৃণা পুঞ্চিভূত হলো তালিবানিদের বিরুদ্ধে। হয়তো আরো বেশি ড্রোন বিমান শান দিচ্ছে তাদের দাত আরো ব্যাপক মরণ কামড় দেবার জন্য তৃতীয় বিশ্বের গরীব মুসলিম দেশগুলার উপরে।

পাকিস্তান আফগানিস্তান ইরাকে নানা রকম যুদ্ধবিমানে তালিবান মারার নাম করে অজস্র শিশুদের নিয়ত হত্যা করছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। এমনকি মালালা মার্কিন হামলায়ও নিহত হতে পারতো। সেখানে শত শত শিশুর গোরস্তান থেকে মালালাকে নিয়া ফায়দা লুটাই সাম্রাজ্যিক বাসনা। খানিকটা ধর্ষিতাকে ধর্ষণের উপকারিতা বোঝানোর মতই। মালালাকে সর্বোচ্চ সেবা দিয়া পাকিস্তানি সরকার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভাল করে তুলবে তাদের প্রয়োজনেই। আমরাও চাই মালালা ভাল হয়ে উঠুক। কিন্তু মালালা ভালো হয়ে উঠাকে কেন্দ্র করে তালিবান বিরোধীতা করতে গিয়ে তা যেন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে চলে না যায়। সেই সতর্কতাই এখন জরুরি।

ফরহাদ মজহারের রাষ্ট্রবাসনার আকার ইকার


পহেলা কিস্তি.. ..

অদ্য বাদফজর যুগান্তর পত্রিকায় নয়া প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রপাগান্ডিস্ট ফরহাদ মজহারের ‘আরেকটি বড় ধরনের সংঘাত আসন্ন’ শিরোনামা একখানি লেখা পড়িলাম। বরাবরের মতই লেখাটায় তিনি নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করিতে যাইয়া নানান ধরনের ফন্দিফিকিরের সহিত নানান তত্ত্বের তালগোল পাকাইয়াছেন। একজন পাঠক হিসাবেই তাহার সহিত দ্বিমতের জায়গাগুলা আমাদের লাহান আমজনতার পরিষ্কার হওয়া উচিত। তিনি এমন এক রাষ্ট্রবাসনা করিয়াছেন যাহা কিছুটা সাকার কিছুটা নিরাকার। এক্ষণে তাহার রাষ্ট্রবাসনা বুঝিতে পারিলে বুঝা যাইবে খোদ তিনিই কোথায় খোদগিরি করিতেছেন।ফরহাদের আলোচনার ঢং এতই নেক্কারজনক যে নিজেকে স্থীর রাখা দায় হইয়া দাড়ায়। তিনি ক্ষণে ক্ষণে লেখার ভেতর নিজেকে হাজির করিতেছেন পণ্ডিত হিসাবে, সবজান্তা সিদ্ধিবাজ হিসাবে। পাঠককে তিনি নিজের উম্মতের লাহান ভাবিতেছেন। নিন্মমানের লেখকদিগের এ এক কুদরতি সন্দেহ নাই।

ফরহাদ কহিবেন,

সমাজ কোন বিমূর্ত ব্যাপার নয়, তবে পত্রিকার পাতা সমাজতত্ত্ব নিয়ে আলোচনার উপযুক্ত জায়গা নয়। তবুও এটা বোঝা দরকার যে সমাজ আমাদের নিজ নিজ চাহিদা পূরণের বাধা হয়ে হাজির থাকে, একই সঙ্গে সেই সমাজই আবার চাহিদা পূরণের উপায়ও বটে। যেমন, আমাকে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই চাকরি করতে হয়, ব্যবসা চালাতে হয় ইত্যাদি। সমাজের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে আমার স্বার্থের সংঘাত আছে, তেমনি নিজের শ্রেণী, গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সঙ্গেও অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকে। সমাজ কখনোই দ্বন্দ্বমুক্ত নয়। এসব দ্বন্দ্ব^ও অস্বাভাবিক কিছু নয়। দ্বন্দ্ব-সংঘাত আছে বলেই সবার সর্বজনীন স্বার্থরক্ষার দরকারে রাষ্ট্রও গড়ে ওঠে। সেখানে সবাই নাগরিক। রাষ্ট্রের পরিসরে এবং রাষ্ট্রের চোখে আমরা আর আলাদা বা ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ের কেউ নই। রাষ্ট্র সব নাগরিকের প্রতি বৈষম্যহীন বা সমান আচরণ করতে বাধ্য। যে রাষ্ট্র এই কাজ করে না, সেই রাষ্ট্র টেকে না। সমাজের ভারসাম্য এতে নষ্ট হয়। যারা এই রাষ্ট্রে বঞ্চিত বোধ করে তারা বিদ্রোহ করে। 

পাঠকমশাই খেয়াল করিবেন পহেলা লাইনে ব্যাপার নয়, উপযুক্ত জায়গা নয়, এটা বোঝা দরকার যে, ইত্যাদি বাক্যংশ দ্বারা তিনি পাঠকের কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করিবার কোশেশ করতেছেন। যাহাহউক উক্ত পেরায় ফরহাদের রাষ্ট্রবাসনার খানিক আভাস পাইতেছি। এদিকে তিনি দ্বান্ধিকতাকে সমাজ বিকাশের পথ হিসাবে বহাল করিয়া নিজেকে বস্তুবাদি হিসাবে দাড় করাচ্ছেন পরক্ষণেই রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নির্ধারণে নিজেকে সুবিধাবাদি হিসাবে হাজির করিতেছেন। যেই দ্বান্ধিক পদ্ধতিতে তিনি সমাজবিকাশের পথকে আগাইবার পথ বা বিকশিত হইবার পথ বলিয়া বাতলাইতেছেন  সেই লাইন ধরিয়া আগাইলে রাষ্ট্র গঠনের নৃতাত্ত্বিক বয়ানও হাজির হইবে। অথচ তিনি তাকে বিকৃত করিতেছেন অথবা তিনি তা বুঝিতে পারেন নাই। তাহার তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্র সমাজ বিকাশের একটা পরিণতি নহে, ইহা আসমান হইতে সংবিধান নিয়া পড়িয়াছে।

সংক্ষেপে বলিতে গেলে বলিতে হয় মানুষ যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির আড়ৎ হইয়া উঠে অর্থাৎ তার সম্পদ এতই বাড়িতে থাকে যে তাহা পাহারা দিতে হয়, তাহার লাইগা আলাদা বাজার ব্যবস্থা করিতে হয়, আলাদা শ্রমবিক্রেতা দরকার, তখনই রাষ্ট্র গড়িয়া উঠিবার শর্তও দেখা যায়। রাষ্ট্র গঠনের মূলে আছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা। সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা পুঁজিবাদেরও পহেলা শর্ত।

মহামতি লেলিন মশাই বলিবেন,

রাষ্ট্র হলো একটি শ্রেণির উপর অন্য একটি শ্রেণির আধিপত্য বজায় রাখার যন্ত্র। যখন সমাজে কোনও শ্রেণি ছিল না, যখন দাসত্বের যুগের আগে মানুষকে খাটতে হতো অধিকতর সমতার আদিম অবস্থায়, শ্রমের উৎপাদনী ক্ষমতার মান ছিল নি¤œতম, আর আদিম মানুষকে অত্যন্ত আদিম ধরনের জীবনযাপনের ব্যবস্থা করতেও খুব বেগ পেতে হতো তখনো সমাজের উপর শাসন ও আধিপত্য চালানোর জন্য বিশেষভাবে বিচ্ছিন্ন করা একদল লোকের উদ্ভব হয়নি, হওয়া সম্ভবও ছিল না। শুধুমাত্র যখন সমাজে প্রথম শ্রেণিবিভাগ দেখা দিল, যখন দাসত্ব দেখা দিল, যখন একেবাওে প্রাথমিক ধরনের কৃষিকাজের উপর জোর দিয়ে একটি বিশেষ শ্রেণি কিছু বাড়তি উৎপাদন করতে পারলো, যখন এই উদ্বৃত্ত আর দাসদেও অত্যন্ত হীন জীবনধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় থাকলো না এবং এই উদ্বৃত্ত দাসমালিকদেও হাতে গেল, যখন এইভাবে দাসমালিক শ্রেণির অস্তিত্ব বেশ কায়েম হয়ে উঠলো, তখন তাদেও অস্তিত্ব পাকাপোক্ত করার জন্য রাষ্ট্রের উদ্ভব নিতান্ত দরকার হয়ে পড়ল।

সবসময় দেখা গিয়াছে বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলাতে, তাহাদিগের সংবিধানে বড় বড় কথা থাকিলেও সবসময় রাষ্ট্র টিকে থাকে শোষণের উপর ভিত্তি করিয়াই। শোষক আর শোষিতের সমানাধিকার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শুধু যে হাস্যকর তাহা নহে অসম্ভবও। আর তাই এইসব রাষ্ট্রে সবসময় অঘোষিত গৃহযুদ্ধ বিরাজ করিবেই। কারণ বাজার ব্যবস্থার দ্বারা শোষিতরা যেইভাবে নির্যাতিত হয় তেমনি ভোগি হইয় উঠিবে শোষক সম্প্রদায়। অথচ ফরহাদ মজহার যেই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সাম্যবাদের হাত পাও খুঁজিতেছেন তিনি মালুম করিতে পারেন নাই তাহা নিরাকার। বৈষম্যই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট, ফলে তাহার থেকে তৈরি হওয়া দ্রোহভাবকে নিস্ক্রিয় করতে বুর্জোয়া রাষ্ট্র অনেক ছলছাতুরি ও শক্তিপ্রয়োগের আশ্রয় লয়।

চলিবে.. .. .. .. 

স্বাধীনতার পহেলা শর্তই কথা বলবার স্বাধীনতা


ব্লগিং বলতে আমরা প্রথমে সামহোয়ার ইনকেই জানতাম। সামহোয়ার ইনে আমার বয়স ৬ বছর ৯ মাস। ব্লগিং দ্রুত জনপ্রিয় হবার পেছনে অর্থনৈতিক রাজনৈতিক কারণ নিহিত। ব্লগিংয়ের আগে পত্রিকাগুলা নিয়ন্ত্রণ করতো পুঁজিপতি পত্রিকা মালিক, এখনো তাই। কিন্তু ব্লগিং সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দেয়। যে কেউ নিজের মতামত জানাতে পারা এবং সাথে সাথে বিষয়টা নিয়ে তর্কে মেতে উঠা ইত্যাদি কারণে ব্লগিং খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠে। তবে মতামত প্রকাশের এই অবাধ স্বাধীনতার কারণে অনেক সম্ভাবনাময় স্বাধীণচেতা প্রতিবাদি তরুণ যেমন নিজেদের একটা বলিষ্ট অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে তেমনি অজস্র প্রপাগান্ডিস্ট আত্মম্ভরী দুর্বলচিন্তার ব্লগারও আমরা পেয়েছি। এখন  অজস্র ব্লগ।

তো ব্লগ আসলে একটা প্লাটফর্ম। নিজের কথা নিজের মত করে বলার। আস্তিকনাস্তিকবিএনপিআওয়ামশিবির সবাই আছে ব্লগে। আবার সবারই আলাদা আলাদা ব্লগ আছে। এখন কথা হচ্ছে যারা ব্লগে লেখে বা ব্লগিং করে তাদেরকে ব্লগার বলা হয়। তাহলে আস্তিকনাস্তিকবিএনপিআওয়ামশিবির সবাই ব্লগার হতে পারে। আজ হেফাজতিরা ব্লগার মানে নাস্তিক বলার যেই কোশেশ করতেছেন সেইটা গায়ের জোরে মুর্খামি  ও গুপ্ত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু না।

সামহোয়ারে অসাধারণ কিছু তীক্ষ্ন মেধাবি লেখক পেয়েছিলাম তাদের মধ্যে ব্লগার হিসাবে আটক রাসেল পারভেজ অন্যতম। সামহোয়ারের তার বয়স ৭ বছর ১ মাস। রাসেলের যুক্তির যেই গভীরতা ও তা প্রয়োগের নিজস্ব কৌশল খুব দ্রুত ব্লগারদের ভেতর তার একটা অবস্থান তৈরি করে। ব্লগাররা রীতিমতো ভয় পেতাম তাকে। কারণ সামহোয়ারে যে কাউকে চ্যালেঞ্জ করবার ক্ষমতা রাখতো রাসেল। তার পড়াশোনার গভীরতাও ছিল বিশাল। তখন রাসেল আমেরিকায় থাকতো। শুধু রাসেল কেন সেই সময়ে অনেক আলোকিত ব্লগারদের পেয়েছিলাম। সাদিক আলম, আরিফ জেবতিক, ব্রাত্য রাইসু, শোহায়েল মোতাহের চৌধুরী, সুমন চৌধুরী, বাকী বিল্লাহ, ইমন জুবায়ের, হাসান মোর্শেদ, শুভ, পিয়াল, হিমু ইত্যাদি। এরা সবাই ছিলেন একসময় সামহোয়ারের নিয়মিত ব্লগার।

রাসেলের যেই জানাশুনা আমরা ধরেই নিয়েছিলাম রাসেল আমেরিকা থেকে ফিরে বড় কোনো হাউজে ঢুকবে। ততদিনে রাসেলের সাথে আমাদের ব্যক্তিগত জানাশুনা হয়। বন্ধুত্ব হয়। নানান বিষয়ে পরষ্পরের মতামত ব্যক্ত করি। ক্রমে রাসেলকে জেনেছি একজন সাধারণ মানুষ হওয়া যার জীবনের ব্রত। অসাধারণ সংবেদনশীল। রাজনীতি সচেতন, অ্যাকটিভিস্ট, পড়–য়া। শেষে শিক্ষগতাকেই বেছে নিয়েছে পেশা হিসাবে। আমরা অনেকেই আহত হয়েছিলাম। কিন্তু রাসেল আপোষহীন। যদিও সে কখনোই আত্মপক্ষ সমর্থন করতো না আমাদের কাছে, এমনকি নিজের বিষয়ে কোনো কথা বলতেই পছন্দ করতো না সে। একটা হালকা টিশার্ট,জিন্স আর চটি পড়েই থাকতো সারাদিন।


তাকে ভাবতে দেখেছি দেশের মানুষ নিয়ে, দেশের অরাজক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। তার প্রত্যেকটি লেখা আর স্ট্যাটাসেই রয়েছে তার প্রমাণ। এরকম নীরব দেশ ও মানুষ প্রেমিক মানুষ এখন বিরল। সে রাসেল পারভেজকেই দেশ ও দেশের মানুষ নিয়ে চিন্তা করার পুরষ্কার দিয়েছি আমরা কম্পিউটার চোরের বেশে ছবি তুলে সংবাদ মাধ্যমগুলাতে। সেই রাসেল পারভেজকেই আমরা দেশ নিয়ে চিন্তা করবার কারণে আজ জেলে পুরেছি আমরা, রিমান্ডে নিয়ে তার হাতপা ভাঙ্গার পায়তারা করতেছি।

তাও আবার হেফাজতে ইসলামি সেজে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে চাওয়া ষড়যন্ত্রকারীদের অনুরোধে। তাও আবার করছে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের একটি দল যাদের নেতৃত্বে একাত্তরের যুদ্ধ হয়েছিল। আওয়ামীলীগ সম্পর্কে মহাত্মা আহমদ ছফা বলেছিলেন, আওয়ামীলীগ হারলে সবাই হারে, জীতলে একাই জেতে। তাইকি আবার প্রমাণ করতে যাচ্ছে আওয়ামীলীগ যে ভোটে জেতার জন্য দেশপ্রেমিক মেধাবী তরুণদের জানকোরবান করতেও দ্বিধা করবে না তারা। মেধাবি চিন্তকদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার আর নাস্তিক তকমা দিয়ে দেশকে মেধাহীন  করার যেই ষড়যন্ত্র যুদ্ধপরাধীরা শুরু করেছে তারই গড্ডালিকায় গা ভাসাবে আওয়ামীলীগ? যদি তাই করে আওয়ামীলীগ তবে আমাদের আবার সেই সিদ্ধান্তেই ফিরে যেতে হবে প্রত্যেক আওয়ামীলীগের ভেতর একেকজন ক্ষুদ্র জামাতকর্মি বাস করে। আওয়ামীলীগও মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি নয়।

আমরা অতিদ্রুত দেশপ্রেমিক সুলেখক ব্লগার রাসেল পারভেজসহ অন্যান্য ব্লগারদের মুক্তি দাবি করি। মুক্তচিন্তা একটা জাতির নিশ্বাস নেবার মতই অধিকার সেটা বন্ধ করবার অধিকার কোন সরকারের নাই। স্বাধীনতার পহেলা শর্তই কথা বলবার স্বাধীনতা। সে বন্ধ করবার পায়তারা যেই করুক সেই স্বাধীনতার শত্রু।