Sunday, April 14, 2013

ম্যাডোনার ট্যাটু ও মালালা ইউসুফজাইর সংবাদ হয়ে উঠা


১৪ বছরের পাকিস্তানি কিশোরী মালালা ইউসুফজাই দুনিয়ার এখন শীর্ষসংবাদ। বিশ্বমিডিয়া মালালার ব্যাপারে যে রকম সহানুভূতি দেখাচ্ছে মানবিকতার দোহাই দিয়া তা শুধু মানবিকতায় আবদ্ধ কিনা তা খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে। বিশেষ করে ম্যাডোনার মত পপ শিল্পী নিজের উন্মুক্ত আবেদনময় দেহে মালালার নামে ট্যাটু লাগিয়ে হাজার হাজার দর্শকশ্রোতার সামনে তা পরিদর্শন এবং তার নামে গান উৎসর্গ করে বিশ্ব মিডিয়ায় সংবাদটার গুরুত্ব বাড়িয়ে দেয়া কোনো রাজনৈতিক এজেন্ডা কিনা তা নিয়াও প্রশ্ন তোলা যেতে পারে।পশ্চিমা মিডিয়া দুইভাবে কাজ করে। প্রথমত তারা সংবাদের ভিত্তি ও উৎস তৈরি করে। দ্বিতীয়ত হয়ে উঠা সংবাদকে নিয়ন্ত্রণ করে।

সেইটা ম্যানুফেকচারিং কনসেন্টে নোয়াম চমস্কি ও এস হারমান বিস্তারিত দেখিয়েছেন। সেই ঘটনা পুরানা। আবার এটা বলাও আমার উদ্দেশ্য নয় যে মালালা মিডিয়ার সৃষ্টি। শুধু মালালা নয় তৃতীয় বিশ্বে অনেক প্রগতিপন্থী মানুষ এই ধর্মীয় কুপমণ্ডুকতার ব্যাপারে সোচ্ছার। কিন্তু সোচ্ছার হলেও এই প্রগতিশীলরা এখন চরম বিপজ্জনক অবস্থানে আছেন। কারণ একদিকে ধর্মীয় কুপমণ্ডুকতা অন্যদিকে তাদের সৃষ্টিকর্তা সাম্রাজ্যবাদ। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বসহ গোটা দুনিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে ঠাণ্ডা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে মার্কিন-সোভিয়েত বিরোধকে কেন্দ্র করে নতুন করে ধর্মীয় ও আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটে। আজকের যেই অন্ধ পশ্চাৎপদ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়া মালালা নির্মমতার শিকার । তারও জন্মদাতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বলা যায় সাম্রাজ্যবাদ নিজের লেজই কামড়ে চলেছে এখন।

তৃতীয় বিশ্বের প্রগতিশীলরা যেন চিন্তার পুলসেরাত পার হচ্ছেন। কারণ তাদের তীব্র সতর্কাবস্থায় চিন্তা করতে হচ্ছে যে তালিবান বিরোধীতা যেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষপাত হয়ে না যায়। সেইরকমই এক সমস্যাসঙ্কুল অবস্থার ভেতর পড়েছেন মালালা ইউসুফজাই। মালালা তালিবানদের বিরুদ্ধে সোচ্ছার হয়তো তার নিজের অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতেই। পুঁজিবাদের খাদ্য সাধারণ গণমানুষ। সেই গণমানুষের দ্বারাও শোষিত আরেক শ্রেণি হচ্ছে নারী। তৃতীয় বিশ্বেতো বটেই তালিবানদের দ্বারা বিশেষভাবে শোষিত ও লাঞ্চিত এই নারীগোষ্ঠী। নারীকে বস্তাবন্দী করে রাখার যেই ধর্মীয় রাজনীতি তা শ্রেণিযুদ্ধে পর্যবসিত হতে বেশিক্ষণ সময় লাগে না। তার দায় মানুষের স্বভাবের। আর স্বভাব তৈরি হয় তার অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর। যে জন্য তৃতীয় বিশ্বে অহরহ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের পুরুষের হাতে নারী ও শিশুহত্যা সংগঠিত  হচ্ছে নিয়ত।

তালিবানরা আমেরিকার মত শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেও বিভিন্নভাবে নিরন্তর মারখাওয়ার ফলে শ্রেণিশত্রু হিসাবে তাদেরকেই তারা টার্গেট করছে যারা অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী কিন্তু যাদের মতামত তাদের বিরুদ্ধে। ফ্যাসিজমের দিক দিয়ে তারাও সাম্রাজ্যবাদের কাছাকাছি। যারা আমাদের পক্ষে না তারা আমাদের বিপক্ষে। এই তাদের ন্যায়। অন্যদিকে শক্তির অবদমন হিসাবে তারা ধর্মের দোহাই দিয়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল করে রাখা নারীদের ব্যাপক শোষণে উৎসাহী। তারা যে শুধু নারীকে শিক্ষা ও সুবিধা বঞ্চিত করে অন্ধকার বোরখার ভেতরই আবদ্ধ রাখতে চায় তা না। তারা ব্যাপক ধর্ষণ বা ভোগের উপকরণ করে রাখার পক্ষপাতিও।

নারীপুরুষ নির্বিশেষে যে সব মানুষ, মানুষের স্বাধীনতায় আস্থা রাখে তারা এমন ঘটনা কোনোদিনও মেনে নিতে পারে না। ঠিক এই ধারার একটা ছোট প্রতিবাদের শিখা ছিল মালালা। কিন্তু বারুদ ছোট হলেও যে ব্যাপক গ্যাসক্ষেত্রে দুর্ঘটনা ঘটেছে যেখানে বিস্ফোরিত হবার জন্য উন্মুক্ত হয়েছে মানবিক বিষ্ফোরক। সেই ক্ষেত্র মালালাকে লুফে নিয়েছিল। আর তাই তালিবানদের বুলেট খুঁজে নিয়েছে মালালাকে। মালালাদের মত বিপ্লবীদের কোনো সংগঠন নাই। তাদেরকে একাই লড়তে হয়। আর তাই যে কোনো মুহূর্তে হেরে যাবার, মরে যাবার বা ব্যবহৃত হবার সমূহ সম্ভাবনা দেখা দেয়। হয়তো মৃত্যু তাদের জন্য অনেক ভাল এমনকি বেঁচে থাকার চেয়েও।

মালালা এখন মার্কিন ও পাকিস্তানি বুর্জোয়াদের প্রিয় ফুলে পরিণত হয়েছে। মালালাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের জনমত আরো তালিবান বিরোধী ও নিজেদের আরো বেশি মানবিক প্রমাণ করার জন্য তারা উঠেপড়ে লেগেছে। সম্মতি উৎপাদনে মালালা বিশেষ অস্ত্রে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান সরকার মালালার খুনীদের মাথার জন্য লাখ লাখ টাকা বাজি ধরেছে। আমিরিকাসহ বিশ্বমিডিয়া দারুণ প্রচার দিচ্ছে মালালাকে। এমনকি যৌনআবেদনময়ী গায়িকা ও নায়িকা ম্যাডোনার খোলা দেহে মালালার নাম খোদাই হয়ে গেছে।হলিউডের পুরা ইন্ডাস্ট্রিটাই প্রায় মার্কিন বুর্জোয়াদের দখলে। তাদের অধিকাংশই জায়ানিস্ট। মেডোনার জেরুজালেম কানেকশান স্বতসিদ্ধ বেপার। তিনি ঘোষণা দিতেও কসুর করেন না। তো মেডোনার গ্রহণযোগ্য আসলে কিসে? সেই গ্রহণযোগ্যতার সাথেই কিন্তু মালালাকে মার্কেটিং করা হচ্ছে। এইখানে মার্কেটিং শব্দটা কঠিন শোনালেও সেইটা সহ্য করবার সময়তো চলছে। অ্যারাইবাল বইলা একটা ডকুমেন্টারিতে একবার দেখানোর চেষ্টা করছিল তারা যে মেডোনার গানের কথাও নিয়ন্ত্রিত হয় জেরুজালেম দ্বারা, তার স্পন্সরদের মধ্যে প্রায় সবাই জায়নিস্ট। তো এই যুদ্ধের গোড়ার ফিরে গেলে বুঝা যাবে মালালাও বস্তুত ড্রোনের শিকার।এতে করে ম্যাডোনার যৌনতার সাথে মালালাকে ব্র্যাণ্ডিং করা হচ্ছে। ম্যাডোনার দেহভঙ্গি ও কামকণ্ঠ গিলতে আসা হাজার হাজার দর্শকশ্রোতা ম্যাডোনা কেন্দ্রিক যৌন অনুভূতির সাথে মালালাকেও সম্পৃক্ত করে নিল। আর সেই প্রচারে আরো বেশি ক্ষোভ ও ঘৃণা পুঞ্চিভূত হলো তালিবানিদের বিরুদ্ধে। হয়তো আরো বেশি ড্রোন বিমান শান দিচ্ছে তাদের দাত আরো ব্যাপক মরণ কামড় দেবার জন্য তৃতীয় বিশ্বের গরীব মুসলিম দেশগুলার উপরে।

পাকিস্তান আফগানিস্তান ইরাকে নানা রকম যুদ্ধবিমানে তালিবান মারার নাম করে অজস্র শিশুদের নিয়ত হত্যা করছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। এমনকি মালালা মার্কিন হামলায়ও নিহত হতে পারতো। সেখানে শত শত শিশুর গোরস্তান থেকে মালালাকে নিয়া ফায়দা লুটাই সাম্রাজ্যিক বাসনা। খানিকটা ধর্ষিতাকে ধর্ষণের উপকারিতা বোঝানোর মতই। মালালাকে সর্বোচ্চ সেবা দিয়া পাকিস্তানি সরকার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভাল করে তুলবে তাদের প্রয়োজনেই। আমরাও চাই মালালা ভাল হয়ে উঠুক। কিন্তু মালালা ভালো হয়ে উঠাকে কেন্দ্র করে তালিবান বিরোধীতা করতে গিয়ে তা যেন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে চলে না যায়। সেই সতর্কতাই এখন জরুরি।

No comments:

Post a Comment