Sunday, April 14, 2013

ববিতা বড়ুয়াকে কি করে বাঁচাবো?


মেরুংলোয়া বড়ুয়াপাড়ার দিকে ঢুকবার আগে সীমা বৌদ্ধবিহারের গেইটে এসেই আমার মনে পড়লো ববিতার কথা, আকস্মিক। কারণ এই সেই গেইট আজ থেকে ১০ বছর আগে আমি এখানে খুঁজতে এসেছিলাম ববিতাদের বাড়ি। আর এখন খুঁজতে এসেছি অজস্র পোড়া বসতবাড়ি। গোলমাল হয়ে যাচ্ছিল বারবার। কিছুদিন ববিতা আমার খুবই কাছের বন্ধু হয়ে উঠেছিল। কারণ সে কবিতা ভালবাসতো। ভাল কবিতা আবৃত্তি করতো। অবশ্য ববিতার বাড়িতে আসার পেছনে ছিল সেই দুর্দমনীয় ধর্মীয় বিধিনিষেধ ভাঙার চেষ্টা। আমি প্রথম ববিতার কাছে শুকরের মাংস খেতে চেয়েছিলাম। কারণ এই জিনিস কেবল মাত্র বড়ুয়ারা খায় এইদিকে। প্রথমে গররাজি হলেও আমার অনমনীয়তার কাছে ববিতা হার মানে। একদিন ববিতা আমার কাঙ্খিত মাংস রান্না করে দাওয়াত করেছিল। এর আগে কোনোদিন আমি ববিতাদের বাড়ি যাই নাই। যদিও কক্সবাজারে সংস্কৃতিক রাজধানী রামুতে গেছি অনেকবার। সীমাবিহারের গেইট দিয়ে ঢুকেছিলাম ঠিকই কিন্তু ববিতার বাড়ি খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল না। ববিতাই খুঁজে বের করেছিল আমাকে।  কিন্তু ববিতার বাবা আমতা বাধা দিয়েছিল কিন্তু ববিতা বলেছিল ‘জাহেদ্যা আধা বউরগ্যা’। আমার বৌদ্ধপ্রীতি সম্পর্কে ববিতা খানিকটা অবহিত ছিল।...


আজ এত বছর পর আমি আবার সীমাবিহারের গেইট দিয়ে ঢুকছি, এইবার আমার লক্ষ্যবস্তু মানে বড়ুয়াদের পুড়ে যাওয়া বসতবাড়ি খুঁজে পেতে আমার বেগ পেতে হয় নাই। কারণ তা দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল। সীমা বিহারের গেইট দিয়া ঢুকতেই নাকে এসে ধাক্বা মারে পোড়াগন্ধ। বৃষ্টির কারণে কালো হয়ে আছে রাস্তার কাদামাটি। ক্রমে আতংকিত বড়ুয়াদের অজস্র মুখ আমাকে অপরাধী করতে করতে পাশ কেটে যায়। এইটা মুসলমান হিসাবে নয় একজন মানবজাতির সদস্য হিসাবেই। 


প্রথম যে কয়টা ঘর আগুনে ভস্ম করা হয়েছিল। আগুনের তাপে ফেটে যাওয়া দেয়ালের প্লাস্টার। একসাথে উকি দেয়া বড়ুয়া মহিলাদের আতংকিত মুখ।যারা একমাত্র পরণের শাড়িটাই বাঁচাতে পেরেছিল।  সেগুলা খুঁজে পেতে আমার কষ্ট হয় নাই। এগুলা দেখতে দেখতে আমার মনে পড়ে যাচ্ছিল। এইখানকার এক মেয়ের সাথে আমার পরিচয় ছিল। মনে হচ্ছিল তাদের বাড়ি আরো ভেতরের দিকে। যাদের বাড়িতে আমি প্রথম শুকরের মাংস খেয়েছিলাম। ববিতার নামটা তখনো মনে পড়ছিল না। চেষ্টা করতেছিলাম কোন এক নায়িকার নামে নাম ছিল যেন মেয়েটার। কি নাম কি নাম। মেয়েটা রামু কলেজের কম্পিউটার ইন্সট্রাকটর। কি নাম কি নাম। এইটা ভাবতে ভাবতেই একটা পুড়ে যাওয়া দোকানের সামনে এসে পড়ি।


অমায়িক, অসহায় দোকানি বর্ণনা করছিলেন সেই বিভীষিকাময় রাতের। গল্পটা তিনিই প্রথম আমাকে বলেন যে, একবাড়িতে মুসলমানরা বাড়ির সকল সদস্যকে ভেতরে রেখে তালা মেরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারা পেছন দিক দিয়া পালাতে সক্ষম হয়েছিল। বাড়ির কোনো জড়বস্তুই বাঁচতে পারে নাই। দুইটা ডেস্কটপ একটা লেপটপ। চারটা পড়ার টেবিল। দুইসেট সোফা। সত্তর হাজার টাকা। বাড়ির ছয় সদস্যের জামাকাপড় খাট বিছানা তোষক বালিশ কিছুই বাঁচতে পারে নাই। দোকানি আমাকে অনুরোধ করল আমি যেন তার সাথে ভেতরে গিয়া বাড়িটা দেখে আসি, বলল সে মিছা বলছে না। আমার চোখে কি তার কথা নিয়া সন্দেহ ছিল কোনো? হয়তো বা।


দোকানের পেছন দিয়া সে আমারে নিয়া যায় বাড়িটায়। ঢুকতেই এক বয়স্ক ফর্সা রাগান্বিত মুখ দেখতে পেলাম। সাদা লুঙ্গি আর সাদা পাঞ্চাবি পড়ে বয়স্ক মানুষটি ধ্বংশস্তুপের মধ্যে একটা প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে আছেন। এক দৃষ্টিতে  তাকিয়ে আছেন সামনে বৃষ্টির সাথে ভেসে যাওয়া কালো পানির দিকে। ঘরটার কালো দেয়াল ছাড়া অবশিষ্ট কিছু নাই। সকালে বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এসে উপরে তাবু লাগিয়ে গেছে। ফাঁকফোকর দিয়ে বৃষ্টি পড়ছে।
হঠাৎ মানুষটা বলে উঠে নিজে নিজেই, যেন তিনি কাউকে উদ্দেশ্য করে বলছেন না এসব,
কোনো দিন তো বড়ুয়া মুসলমান আলাদা করে দেখি নি?
কেঁপে উঠি।
তিনি বলে উঠেন, আমার একমেয়ে রামু কলেজে চাকরি করে, আরেক মেয়ে বিসিকে, আরেক মেয়ে প্রাইমারি স্কুলে।
চমকে উঠি।
ততদিনে ববিতা কোথায় কাজ করতো সেসবও মনে নাই আর। হঠাৎ ভেতরের দিক থেকে ভেসে আসলো এক নারীকণ্ঠ, কে আসছে ওখানে বাবা..। 
দেখেই চিনতে পারলাম তাকে।
ববিতার বড়বোন। করবীদি আমাকে চিনতে পারেন নাই। বললেন আপনারা কোত্থেকে এসেছেন। রাগান্বিত করবীদির কণ্ঠস্বর। আমি বাকরুদ্ধ। আমি কোত্থেকে এসেছি? কোত্থেকে? কেন এসেছি এইখানে, নিজেও কি বুঝি? সেসব প্রশ্ন আমিও নিজেকে জিজ্ঞেস করছি। কেন, কেন, কেন?
করবীদি কিছু বলার আগেই তার বাবা মেলে দিলেন নিজের দুই হাত। যেখানে আগুনে পোড়া দুইটা দাগ দেখতে পাচ্ছি। আমি ভাবছি আর মনে মনে বলছি কবরীদি যেন আমাকে চিনতে না পারে। এখনো চিনতে পারে নাই। দশবছর আগে মাত্র একবার দেখা হয়েছিল তার সাথে, চেনার কথা না। যদিও আমার চোখ খুঁজে চলে ববিতাকে কিন্তু বাসনা করছি ববিতার সাথে যেন দেখা না হয়। দশবছর পর এরকম এক মুহুর্তে একদার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুর মুখ দেখে সহ্য করতে অনেক শক্ত হতে হয় মানুষের মন। আমি কি অত শক্ত হতে পেরেছি?
নিজের অজান্তেই চলে যাই ভেতরের রুমে। যেখান থেকে পুরা পোড়াবাড়িটা দেখা যায়। পোড়া জানলা দিয়া তাকাতেই চোখে পড়লো এক তরুণীকে হয়তো সে গোসল সেরে ঢুকে যাচ্ছে রান্না ঘরের মতো নিচু একটা ঘরে। মাথায় ভেজা গামছা পেছানো মুখে রাজ্যের দুশ্চিন্তা। সত্যিকার অর্থে আমি তখনও চিনতে পারি নাই ববিতাকে।
হঠাৎ ফিরে জিজ্ঞেস করলাম মানুষটাকে, আপনার সেই মেয়েটা কোথায়, যিনি রামু কলেজে চাকরি করেন? 


ববিতা, ববিতা বলে হাক মারেন কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তিনি। একটু পরেই রুমটায় এসে হাজির হলো ববিতা। ববিতার সেই দরাজ কণ্ঠ। রুমে ঢুকেই বলে কে কে আমাকে ডাকে? আমি মুখ লুকাতে পারলে বাঁচতাম। ববিতা আমার মুখের দিকে তাকায়। সে মুখ ফেরাতে পারে নাই। ফের তাকায়। কে তুই? চিৎকার করে উঠে সে মনোরোগীর মত। জা ... হে... দ্যা?


ববিতা চিনতে পারার পর ঘরের সবার চোখ আমার দিকে জড়ো হয়। চোখগুলা আমাকে শনাক্ত করার চেষ্টা করে। ববিতা বলে চলে, জাহেদ্যাকে চিনতে পারছেন না,আপনারা? সেই আধা বউরগ্যা। আমাদের বাড়িতে এসেছিল, শুকরের মাংস খাওয়ার জন্য।
করবীদি চিনতে পারে। মাসিমা চিনতে পারে। মাসিমার কান্নাসিক্তমুখটা আমার বুকে রেখে ফুফিয়ে উঠে। আমি ঘুরছি সব স্মৃতিফৃতিসহ, ঘুরছে আমার অস্তিত্ব।  ববিতা আমাকে হাত ধরে ভেতরের দিকে নিয়া চলে। নিতে নিতে দেখাতে থাকে আগুন কোথায় লাগানো হয়েছিল, কিভাবে বাড়ির টিনের চালে সে সবাইকে তুলে দিয়ে নিজেও লাফ দিয়ে বেঁচেছিল। কিভাবে পাথর এসে পড়ছিল তাদের মাথায় মুখে পিঠে। সে সব বলতে বলতে বাড়িটা প্রদক্ষিণ করলাম আমরা। এই কঠিন বাস্তবতা ভেদ করে দশবছর আগের স্মৃতি ডানা ঝাপটাচ্ছিল। কত বদলে গেছে ববিতা। এখন তাকে চেনাই যাচ্ছে না। হয়তো এতদিন বদলায় নাই, সেদিন রাত থেকেই... তার সদা হাসোজ্জল মুখটা পরিণত হয়েছে করুণ, মর্মান্তিক,আতংকিত, সন্দেহ পরায়ণতায়।  
আমাদের বাড়িতে কি কি ছিল তা তুই জানিস? আমি মাথা নাড়ছি হ্যা। সোফাগুলাতে তুই বসছিলি? হ্যা আমি মাথা নাড়ছি। মনে আছে সেই টেবিলটা? আমার আবৃত্তির ক্যাসেটগুলা? কত কবিতা? তুইযে একটা ক্যাসেট মেরে দিয়েছিলি মনে আছে? 
আমি দুনিয়ায় অনেকের কাছ থেকে কত বই, ক্যাসেট, টাকা নিয়া ফেরত দিই নাই তার কোনো হিসাব নাই। কিন্তু আজ খুবই অপরাধী মনে হচ্ছে নিজেকে। ববিতার ক্যাসেট টা কোথায় আছে খুঁজে দেখতে হবে। ফেরত দিতে হবে। কারণ তারতো এখন কোনো ক্যাসেট নাই। তার সব বইগুলা পুড়ে গেছে।


তুই কি কখনো মুসলমান ছিলি? আমি কি কখনো বড়ুয়া ছিলাম? আমরা তো মানুষ ছিলাম, বন্ধু ছিলাম। তার অবিশ্বস্ত চোখ সম্মতির জন্য আমার নতচোখের দিকে তাকায়। আমি এরকম লজ্জা কোনোদিন পাই নাই। পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করছিল। এই মুসলমানিত্ব, হিন্দুত্ব, বড়ুয়াত্ব ছেড়ে, অন্য কোনো দুনিয়ায় যেখানে বন্ধুত্বই একমাত্র সহায় হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষান্ত হয় না। সে আমাকেই যেন অপরাধী ভেবেছে, যেন তার সমস্ত অভিযোগ আমার বিরুদ্ধেই। 


আমাকে কিভাবে বাঁচাবি তুই, কিভাবে দাঁড় করাবি এই ভাঙ্গা ঘর? কিভাবে ফিরিয়ে নিয়ে আসবি সেই সম্প্রীতি? 


ভেবে চলেছি, ভেবে চলেছি আমি নিরন্তর এই পুঁজিবাদের সৃষ্ট আবর্জনার স্রোত সম্প্রদায়-অন্ধ জনগণের প্রতিনিধি হিসাবেই  'ববিতা বড়ুয়াদের কিভাবে বাঁচাবো আমরা ?'

No comments:

Post a Comment