Sunday, April 14, 2013

ফরহাদ মজহারের রাষ্ট্রবাসনার আকার ইকার


পহেলা কিস্তি.. ..

অদ্য বাদফজর যুগান্তর পত্রিকায় নয়া প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রপাগান্ডিস্ট ফরহাদ মজহারের ‘আরেকটি বড় ধরনের সংঘাত আসন্ন’ শিরোনামা একখানি লেখা পড়িলাম। বরাবরের মতই লেখাটায় তিনি নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করিতে যাইয়া নানান ধরনের ফন্দিফিকিরের সহিত নানান তত্ত্বের তালগোল পাকাইয়াছেন। একজন পাঠক হিসাবেই তাহার সহিত দ্বিমতের জায়গাগুলা আমাদের লাহান আমজনতার পরিষ্কার হওয়া উচিত। তিনি এমন এক রাষ্ট্রবাসনা করিয়াছেন যাহা কিছুটা সাকার কিছুটা নিরাকার। এক্ষণে তাহার রাষ্ট্রবাসনা বুঝিতে পারিলে বুঝা যাইবে খোদ তিনিই কোথায় খোদগিরি করিতেছেন।ফরহাদের আলোচনার ঢং এতই নেক্কারজনক যে নিজেকে স্থীর রাখা দায় হইয়া দাড়ায়। তিনি ক্ষণে ক্ষণে লেখার ভেতর নিজেকে হাজির করিতেছেন পণ্ডিত হিসাবে, সবজান্তা সিদ্ধিবাজ হিসাবে। পাঠককে তিনি নিজের উম্মতের লাহান ভাবিতেছেন। নিন্মমানের লেখকদিগের এ এক কুদরতি সন্দেহ নাই।

ফরহাদ কহিবেন,

সমাজ কোন বিমূর্ত ব্যাপার নয়, তবে পত্রিকার পাতা সমাজতত্ত্ব নিয়ে আলোচনার উপযুক্ত জায়গা নয়। তবুও এটা বোঝা দরকার যে সমাজ আমাদের নিজ নিজ চাহিদা পূরণের বাধা হয়ে হাজির থাকে, একই সঙ্গে সেই সমাজই আবার চাহিদা পূরণের উপায়ও বটে। যেমন, আমাকে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই চাকরি করতে হয়, ব্যবসা চালাতে হয় ইত্যাদি। সমাজের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে আমার স্বার্থের সংঘাত আছে, তেমনি নিজের শ্রেণী, গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের সঙ্গেও অর্থনৈতিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকে। সমাজ কখনোই দ্বন্দ্বমুক্ত নয়। এসব দ্বন্দ্ব^ও অস্বাভাবিক কিছু নয়। দ্বন্দ্ব-সংঘাত আছে বলেই সবার সর্বজনীন স্বার্থরক্ষার দরকারে রাষ্ট্রও গড়ে ওঠে। সেখানে সবাই নাগরিক। রাষ্ট্রের পরিসরে এবং রাষ্ট্রের চোখে আমরা আর আলাদা বা ভিন্ন ভিন্ন পরিচয়ের কেউ নই। রাষ্ট্র সব নাগরিকের প্রতি বৈষম্যহীন বা সমান আচরণ করতে বাধ্য। যে রাষ্ট্র এই কাজ করে না, সেই রাষ্ট্র টেকে না। সমাজের ভারসাম্য এতে নষ্ট হয়। যারা এই রাষ্ট্রে বঞ্চিত বোধ করে তারা বিদ্রোহ করে। 

পাঠকমশাই খেয়াল করিবেন পহেলা লাইনে ব্যাপার নয়, উপযুক্ত জায়গা নয়, এটা বোঝা দরকার যে, ইত্যাদি বাক্যংশ দ্বারা তিনি পাঠকের কাছ থেকে নিজেকে আলাদা করিবার কোশেশ করতেছেন। যাহাহউক উক্ত পেরায় ফরহাদের রাষ্ট্রবাসনার খানিক আভাস পাইতেছি। এদিকে তিনি দ্বান্ধিকতাকে সমাজ বিকাশের পথ হিসাবে বহাল করিয়া নিজেকে বস্তুবাদি হিসাবে দাড় করাচ্ছেন পরক্ষণেই রাষ্ট্রের সংজ্ঞা নির্ধারণে নিজেকে সুবিধাবাদি হিসাবে হাজির করিতেছেন। যেই দ্বান্ধিক পদ্ধতিতে তিনি সমাজবিকাশের পথকে আগাইবার পথ বা বিকশিত হইবার পথ বলিয়া বাতলাইতেছেন  সেই লাইন ধরিয়া আগাইলে রাষ্ট্র গঠনের নৃতাত্ত্বিক বয়ানও হাজির হইবে। অথচ তিনি তাকে বিকৃত করিতেছেন অথবা তিনি তা বুঝিতে পারেন নাই। তাহার তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্র সমাজ বিকাশের একটা পরিণতি নহে, ইহা আসমান হইতে সংবিধান নিয়া পড়িয়াছে।

সংক্ষেপে বলিতে গেলে বলিতে হয় মানুষ যখন ব্যক্তিগত সম্পত্তির আড়ৎ হইয়া উঠে অর্থাৎ তার সম্পদ এতই বাড়িতে থাকে যে তাহা পাহারা দিতে হয়, তাহার লাইগা আলাদা বাজার ব্যবস্থা করিতে হয়, আলাদা শ্রমবিক্রেতা দরকার, তখনই রাষ্ট্র গড়িয়া উঠিবার শর্তও দেখা যায়। রাষ্ট্র গঠনের মূলে আছে ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা। সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা পুঁজিবাদেরও পহেলা শর্ত।

মহামতি লেলিন মশাই বলিবেন,

রাষ্ট্র হলো একটি শ্রেণির উপর অন্য একটি শ্রেণির আধিপত্য বজায় রাখার যন্ত্র। যখন সমাজে কোনও শ্রেণি ছিল না, যখন দাসত্বের যুগের আগে মানুষকে খাটতে হতো অধিকতর সমতার আদিম অবস্থায়, শ্রমের উৎপাদনী ক্ষমতার মান ছিল নি¤œতম, আর আদিম মানুষকে অত্যন্ত আদিম ধরনের জীবনযাপনের ব্যবস্থা করতেও খুব বেগ পেতে হতো তখনো সমাজের উপর শাসন ও আধিপত্য চালানোর জন্য বিশেষভাবে বিচ্ছিন্ন করা একদল লোকের উদ্ভব হয়নি, হওয়া সম্ভবও ছিল না। শুধুমাত্র যখন সমাজে প্রথম শ্রেণিবিভাগ দেখা দিল, যখন দাসত্ব দেখা দিল, যখন একেবাওে প্রাথমিক ধরনের কৃষিকাজের উপর জোর দিয়ে একটি বিশেষ শ্রেণি কিছু বাড়তি উৎপাদন করতে পারলো, যখন এই উদ্বৃত্ত আর দাসদেও অত্যন্ত হীন জীবনধারণের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় থাকলো না এবং এই উদ্বৃত্ত দাসমালিকদেও হাতে গেল, যখন এইভাবে দাসমালিক শ্রেণির অস্তিত্ব বেশ কায়েম হয়ে উঠলো, তখন তাদেও অস্তিত্ব পাকাপোক্ত করার জন্য রাষ্ট্রের উদ্ভব নিতান্ত দরকার হয়ে পড়ল।

সবসময় দেখা গিয়াছে বুর্জোয়া রাষ্ট্রগুলাতে, তাহাদিগের সংবিধানে বড় বড় কথা থাকিলেও সবসময় রাষ্ট্র টিকে থাকে শোষণের উপর ভিত্তি করিয়াই। শোষক আর শোষিতের সমানাধিকার বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে শুধু যে হাস্যকর তাহা নহে অসম্ভবও। আর তাই এইসব রাষ্ট্রে সবসময় অঘোষিত গৃহযুদ্ধ বিরাজ করিবেই। কারণ বাজার ব্যবস্থার দ্বারা শোষিতরা যেইভাবে নির্যাতিত হয় তেমনি ভোগি হইয় উঠিবে শোষক সম্প্রদায়। অথচ ফরহাদ মজহার যেই বুর্জোয়া রাষ্ট্রের সাম্যবাদের হাত পাও খুঁজিতেছেন তিনি মালুম করিতে পারেন নাই তাহা নিরাকার। বৈষম্যই বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট, ফলে তাহার থেকে তৈরি হওয়া দ্রোহভাবকে নিস্ক্রিয় করতে বুর্জোয়া রাষ্ট্র অনেক ছলছাতুরি ও শক্তিপ্রয়োগের আশ্রয় লয়।

চলিবে.. .. .. .. 

No comments:

Post a Comment